যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বিএনপি
একের পর এক যুদ্ধাপরাধীর বিচার কাজ শেষ হবার পথে বা রায় কার্যকর করার সময় দেশ ব্যাপী খুন খারাপী ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। জামাত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ আর বিএনপি’র স্থায়ী কমিটি’র সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বলা যায় আরো একটু বেশি হয়েছে। গুপ্ত হত্যা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা হয়েছে। শুধু প্রগতিশীল লেখক, সাহিত্যিক বা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী নয়, হত্যার শিকার হয়েছে বিদেশিরাও।
দেশের মানুষ এসব নিয়ে যখন গভীরভাবে চিন্তিত তখন সবাইকে বিস্মিত করেছে এই বিচার প্রশ্নে বিএনপি’র রাজনৈতিক অবস্থান। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে দেশের জনমতকে অগ্রাহ্য করে জামাতের সাথে সুর মিলিয়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করলেও দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকার নীতি নিয়েছিল দলটি। কিন্তু এসময় দেখা গেল হঠাৎ আবার সরব হয়েছে দলের নেতারা। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কাতারতো করেইনি, তাকে স্থায়ী কমিটির মতো নীতি নির্ধারণী পদে রেখে তার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল বিএনপি।
এই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেছিলেন এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাকা চৌধুরীর অবদান আছে। সাকা চৌধুরীর মতো একটি অপরাধীকে প্রায় মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দেয়ার মতো বক্তব্য দিলেন রিপন। আর একেবারে শেষ পর্যায়ে সাকার দলীয় সহকর্মী, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, চাক্ষুস সাক্ষী ছাড়া সাকাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সরকারব্যবস্থা, রাজনীতির মাঠে বা সরকার পরিচালনায় সরকারের আচরণ নিয়ে কথা হতে পারে, প্রবল বিতর্কও হতে পারে। বিএনপি একথাও বলতে পারে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের এমন অবস্থান তার দেউলিয়াত্বকেই নির্দেশ করে। স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মানের দোহাই দিয়ে বিচার-প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে সচেষ্ট জামাতে ইসলামীর কাতারে নিজেকে নিয়ে গেছে বিএনপি।
জামাতে ইসলামীর মতো দল, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যারা ছিল পাকিস্তানিদের দোসর, তারা এর বিরোধিতা করবে- সেটা সবাই জানতো। কিন্তু বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল, যে দলের নেতারা দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, সেই দল কেন এই আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলো, তার ব্যাখ্যা মেলে না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের হাজারো অভিযোগ থাকা স্বাভাবিক। সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকবে বিএনপি। কিন্তু সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে গুলিয়ে ফেলার এই রাজনীতি কি প্রত্যাশিত বিএনপি’র কাছে?
অবশ্য প্রত্যাশা যাই থাকুক, দল হিসেবে বিএনপি বরাবরই একটি প্রগতিবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। গণজাগরণ মঞ্চ হওয়ার পর, দেশের তরুণ সমাজ যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে, তখন অন্ধকারের শক্তি, একাত্তরের পরাজিত শক্তির মতো বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও এই মঞ্চকে নাস্তিকদের মঞ্চ বলেছিলেন। আজকে ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে তার পেছনে মদদ দিয়েছে বিএনপি’র দলীয় পত্রিকা আমার দেশ।
একটি দেশের শক্তি ও সাহস জাগ্রত হয় সে ভূখণ্ডের মানুষের অঙ্গীকারের ওপর। কতিপয় দুষ্কৃতিকারি ছাড়া একাত্তরে আপামর জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। অন্যতম বিরোধিতাকারী ছিল জামাতে ইসলামি, যেটি স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশ উল্টোপথে চলা শুরু করে। তারই দর্শনে জিয়াউর রহমান জামাতকে আবার রাজনীতি করার বৈধতা দেয়। সে হিসেবে জিয়াউর রহমান শুধু বিএনপিরই প্রতিষ্ঠাতা নন, স্বাধীন বাংলাদেশে জামাতে ইসলামেরও প্রতিষ্ঠাতা।
বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা প্রায়ই বলে থাকেন, বিচারের নামে আওয়ামী লীগ ‘দলীয় এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন করছে। প্রশ্ন হলো বিএনপি যদি এই বিচার-প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে সমর্থন দিতো তাহলে কি এককভাবে আওয়ামী লীগের এজেন্ডা হতে পারত? তাছাড়া বিষয়টি কখনোই আওয়ামী লীগের একক এজেন্ডা নয়। বাম দলগুলো এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা এই বিচারকে স্বাগত জানিয়েছে।
দেশের দুর্ভাগ্য যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো মৌলিক বিষয়েও বিএনপি এমন একটি বিপরীত অবস্থান নিল। অথচ এদলে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা জানেন যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করছে, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মতো জঘন্যসব ঘটনা ঘটিয়েছে।
একাত্তরে এদেশের মানুষ যখন লড়াই করছিল, তখন যারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তারা সবাই ছিল পাকিস্তানের ‘আদর্শিক’ ও ‘পরীক্ষিত’ কর্মী। নিশ্চিত না হয়ে কাউকে এই বাহিনীতে নেয়া হয়নি। বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার বাহিনীর নীলনকশা অনুযায়ী এই রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, আইনজীবী ও চিকিৎসকদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। ঘাতকদের নৃশংসতা ও বর্বরতার চিহ্ন এখনো ধারণ করে আছে দেশের অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। মানবতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই ঘাতকদের বিচার হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটুকু সত্য যদি বিএনপি অস্বীকার করে তাহলে বুঝতে হবে জামাতের মতো এই দলটিও ক্রমেই যুদ্ধাপরাধী দলে পরিণত হতে চলেছে বা হয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর দালাল আইনে অনেক যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও বিচার-প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক ফরমানবলে দালাল আইন বাতিল করা হয়। দুঃখজনকভাবে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সেই জায়গায় নিয়ে গেছে নিজেকে যার অন্যতম দর্শন এখন জামাতের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন।
এইচআর/এমএস