ভাষায় জাতীয়তাবোধ ও নামের প্রভাব
মো. রহমত উল্লাহ্
আন্দোলন শব্দটির আভিধানিক অর্থ আলোড়ন বা বিক্ষোভ হলেও প্রায়োগিক অর্থ অনেক ব্যাপক। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে আন্দোলন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের এ আন্দোলনে সফলতা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে মাত্র। আমাদের সেই ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
বিশ্বের ১৯৩টি দেশ আজ উদযাপন করছে বীর বাঙালির শহীদ দিবস। আমাদের আত্মত্যাগ এখন বিশ্বস্বীকৃত গৌরবের বিষয়, আলোচনার বিষয়, উদযাপনের বিষয়। ভাষীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলা ভাষার স্থান এখন পঞ্চম। প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে বাংলায়। সময় চলে যাচ্ছে মূল্যায়নের। নিজেকে প্রশ্ন করে জানা অপরিহার্য; বাংলা ভাষার আন্দোলন তথা সঠিক বাংলা চর্চায় আমরা কতটা সফল?
সময়ের তুলনায় আমাদের সফলতা মোটেও সন্তোষজনক নয়। প্রকৌশল, চিকিৎসা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি লেখা ও বলার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা খুব একটা এগোতে পারিনি। ‘শহিদমিনার' লিখতেও আমরা অনেকেই ভুল করি। লিখি ‘শহীদ মিনার’! এক শব্দকে লিখি দুই শব্দে। ই-কার এর স্থলে দিই ঈ-কার। এ ব্যর্থতার কারণ যেমন অনেক, তেমনি মতপার্থক্যও কম নয়।
ভাষা হচ্ছে জাতির প্রাণ। যে জাতির জাতীয়তাবোধ সর্বাধিক সে জাতির ভাষা সর্বাধিক সমৃদ্ধ। যে জাতি যত বেশি ঐক্যবদ্ধ সে জাতির ভাষা তত বেশি প্রখর। যে জাতি যত বেশি সৃজনশীল ও কর্মঠ সে জাতির ভাষা তত বেশি প্রভাবশালী। অথচ আমরা কোন জাতি; বাঙালি না বাংলাদেশী এ বিতর্ক জন্ম দিয়েছি নিজেরাই। বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছি স্বজাতির ঐক্য। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য শিকার ও অস্বীকার করার এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করছে আমাদের উত্তরাধিকার। আমাদের শিক্ষায়, বলায়, লেখায়, গল্পে, নাটকে, গানে, কবিতায়, আজ কোন ঐক্যবদ্ধ সুনির্দিষ্ট ভাবধারা ও ভাষা নেই।
আরবি, বাংলা, ইংরেজি, এই ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে একদল ব্যবহার করছি বাংলা, অন্যদল ব্যবহার করছি ইংরেজি, অন্যদল ব্যবহার করছি আরবি শব্দ। হিন্দি চ্যানেলের বদৌলতে ইদানীং হিন্দি শব্দের ব্যবহারও বেড়েছে অনেক। বাবা, মা, চাচা, ফুফু, খালা, হয়ে যাচ্ছে ড্যাড, মাম, আঙ্কেল, আন্টি, যার মধ্যে কোন হৃদ্যতা নেই! যেন বাংলা ভাষা নিজের ভাষা নয়।
নিজের সন্তান, প্রতিষ্ঠান, উৎপাদিত পণ্যের নাম রাখার সময়ও আমরা বেছে নিই অন্য ভাষার শব্দ; যার অর্থও জানি না অনেকেই। আমার এ কথা শুনে হয়ত কেউ কেউ মনে মনে বলছেন, নামে কী বা আসে যায়? হ্যাঁ, ভাষার ক্ষেত্রে নামে অনেক কিছুই আসে যায়। একটু লক্ষ্য করুন- রিফাত, সিফাত, করিম, রহিম ক্রিকেট খেলে। এই বাক্যটিতে একটিমাত্র বাংলা শব্দ খেলে। বাক্যটি যদি এমন হতো পলাশ, শিমুল, নিপুন, প্রজ্ঞা, প্রতীতি ক্রিকেট খেলে। তাহলে একটি শব্দ মাত্র বিদেশি থাকত, তা হচ্ছে ক্রিকেট।
নিজেদের পণ্য, বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের নাম রাখার সময় আমরা নিজস্ব শব্দ ব্যবহার করছি না। দু-একটি আরবি বা উর্দু শব্দ জুড়ে দিয়ে পবিত্র করার এবং দু-একটি ইংরেজি, চিনা, জাপানি ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিয়ে আধুনিক করার চেষ্টা করছি। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম রাখার ক্ষেত্রেও আমরা বাংলা ভাষা প্রয়োগ করছি না। কোন সমৃদ্ধ জাতির মধ্যে এই হীন মানসিকতা এমনভাবে লক্ষ্য করা যায় না।
আমাদের মধ্যেও এমন হীন মানসিকতা ছিল না; যখন আমরা সবাই বাঙালিত্ব বোধে ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, বাংলা ভাষার ও বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত ছিল। যেমন- সোনালি, জনতা, রুপালি, পূবালী অগ্রণী, বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, সুরমা, কুশিয়ারা, চটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল, ডাকঘর, বেতার, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি শব্দ তখন আমরা ব্যবহার করতাম বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েই। এখন সেই ঐক্য নেই, চেতনা নেই, ভাষা নেই!
অপরদিকে আমাদের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে আমরা উৎকৃষ্ট কর্মের চেয়ে নিকৃষ্ট কর্মেই বেশি শ্রম ও মেধা প্রয়োগে লিপ্ত। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর তথা দরিদ্র। আমাদের তেমন বেশি সৃষ্টি নেই যার নাম বাংলায় রেখে বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিতে পারি এবং সেই পণ্যের সাথে আন্তর্জাতিকায়ন করতে পারি আমাদের ভাষা। আমাদের সর্বাধিক উৎপাদিত মানুষ নামক সন্তানের নামও আমরা রাখি অন্য ভাষায়। আমার নিজের নামটিও বাংলায় নয়।
আমাদের উৎপাদিত প্রাণ সামগ্রী যখন বিশ্ববাজারে যায় তখন প্রাণ শব্দটিও যায়। বাংলায় নাম রাখার কারণেই ভোক্তারা বাংলা শব্দটি ব্যবহার করছে। বাংলার পণ্যের সাথে বাজারজাত হচ্ছে বাংলা ভাষা। যে জাতির শ্রেষ্ঠ পণ্য যত বেশি বাজার দখল করবে সে জাতির ভাষা তত বেশি প্রভাব বিস্তার করবে।
বলপেন যদি আমার সৃষ্ট হতো এটির নাম হতো দ্রুতকলম, কম্পিউটার যদি আমার আবিষ্কার হতো নাম দিতাম প্রাজ্ঞযন্ত্র। প্যারাসিটামলের নাম দিতাম ব্যথাহ্রাশক। বিশ্ববাসী মেনে নিতে বাধ্য হতো এই বাংলা নাম। এটিই বাস্তবতা, এটিই সত্য। আসুন ঐক্যবদ্ধ হই সত্যিকারের চেতনায় অর্জন করি প্রকৃত জ্ঞান। মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করি নতুন নতুন আবিষ্কারে, উৎপাদনে। নাম রাখি নিজের ভাষায় সমৃদ্ধ করি আমাদের দেশ। সমৃদ্ধ করি জাতীয় ভাষা- মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
এইচআর/এমকেএইচ