শুরু হোক আনন্দপাঠ
অবেশেষে দফতরি মামা ঘণ্টা হাতে নিয়েছেন। দশ মাস ব্যবহার না হওয়া ঘণ্টায় হয়তো মরচে পড়ে গেছে। মরচে শুধু ঘণ্টাতেই নয়, বিদ্যায়তনভিত্তিক পুরো শিক্ষাব্যবস্থাতেই জং ধরেছে। এখন ধুয়েমুছে সেই মরিচা সরাতে হবে। ২০২০ ছিল যাদের প্রথম স্কুলে প্রবেশ, সেই শিশুরাতো স্কুলের কথা ভুলেই বসে আছে। আড়মোড়া না ভাঙতেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ।
যাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অভ্যাস পুরোনো, তাদের আসলেমিতে পেয়ে বসেছে। ২০২০ এ যারা এসএসি পাস করল, তারাতো কলেজে পা রাখারই সুযোগ পেল না। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বসা হলো না পরীক্ষার টেবিলে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্তীর্ণ হয়েও তারা অপেক্ষায় আনুষ্ঠানিক ফলাফলের। স্বাভাবিক সময় হলে তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির রণক্ষেত্রে থাকত।
করোনাকাল ধাপে ধাপে ছুটি বেড়েছে। ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রাখতে খোলা হয় অনলাইন ক্লাস। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরোবিশ্বের শিক্ষার্থীদেরই অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থাকতে হয়েছে। শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষার্থী সবাইকেই যুক্ত হতে হয়েছে অনলাইন ক্লাসে।
বাংলাদেশের মতো আর্থিক সামর্থ্যের দেশে, করোনাকালে মানুষের আয় কমলেও অভিভাবককে সন্তানের জন্য একটি স্মার্টফোন তুলে দিতে হয়েছে। স্কুলের বেতন-ভাতা পরিশোধ থেকে ছাড় পাওয়া যায়নি। বিদ্যায়তন কর্তৃপক্ষ কড়ায়গণ্ডায় তাদের পাওনা বুঝে নিয়েছেন। সঙ্গে বাড়তি খরচ ইন্টারনেট। চাকরিহারা, কাজহারা অনেকে এই বেতন-ভাতা দিতে পারেনি বলে বিদ্যায়তন থেকে সাময়িক ঝরে পড়ার হার বেড়েছে।
অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ায়, তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ছন্দপতন ঘটেছে। শহরের স্কুলে পড়তে থাকা শিক্ষার্থী গ্রামে যেয়ে ওখানকার পাঠের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। অন্যদিকে অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের যে স্থানিক দূরত্ব, সেখানে পাঠদান ও গ্রহণের মধ্যেও খাদ থেকে যাচ্ছে।
সুতরাং করোনাকালের এই দশ মাসে সকল স্তরের শিক্ষাতেই ঘাটতি রয়ে গেল। সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো বিদ্যায়তনের যে পরিবেশ ও প্রাত্যহিকতা থেকে দূরে থেকে, শিক্ষার্থীদের জীবনের শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়েছে অনেকটা। অন্যদিকে অনলাইনে পাঠ নিতে গিয়ে মোবাইল বা অনলাইন আসক্তি বেড়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিদ্যায়তন খোলা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ ও ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। এখনও আছে।
কেউ বলছিলেন কোভিডের এই ঢেউয়ের মাঝে সন্তানদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না। স্কুল খুললেও সন্তানকে এ বছর আর বিদ্যায়তনে পাঠাবেন না বলেও অভিভাবকদের অনেকে ঘোষণা দেন সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদ্যায়তন থেকে দূরে থাকা, পরীক্ষা আটকে থাকা, উচ্চশিক্ষার স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যায়তন খুলে দেয়া বলা যায় অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
এই বাস্তবতায় ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করবে, বসবে, সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশনা। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় বেশ গুরুত্ব পেয়েছে নির্দেশনায়, বিদ্যায়তনে আনন্দঘন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। খেলাধুলা, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গাছ লাগানো ও পরিচর্যা, সংগীতচর্চা, ছবি আঁকা ও সামাজিক সেবামূলক কাজ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে মূল্যায়ণ ও আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা রাখা যাবে না। এই নির্দেশনাগুলো আমার ভালো লেগেছে। এমন এক আনন্দপাঠের পরিবেশ সন্তানদের জন্য তৈরি করে দেয়ার স্বপ্নইতো দেখি আমরা।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন পরীক্ষানির্ভর হয়ে পড়েছে। নানা রকম পরীক্ষার চাপে নিমজ্জিত শিক্ষার্থীরা। সন্তানদের জন্য শিক্ষা এখন আতঙ্কের। কোথাও আনন্দপাঠ নেই। পরীক্ষার চোখরাঙানিতে বিদ্যায়তন থেকে সাংস্কৃতিক অনুশীলন প্রায় উধাও। পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞানের যে সমুদ্র প্রবাহিত, ওই সমুদ্রের ঊর্মির সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক নেই।
এই যে আমরা করোনাকালের মাঝেই নয়া স্বাভাবিকত্বে ফেরার চেষ্টা করছি, সেখানে পুরাতনকে মুছে, নতুন করে সাজাতে পারি আমাদের বিদ্যায়তন। সরকারের যে নির্দেশনা, তা অফুরান আনন্দ নিয়ে আসুক স্কুলে ফেরার ঘণ্টার প্রতিধ্বনিতে!
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ