‘রিফিউজি’ না ‘দায়েশ’ না ‘মানুষ’
ব্রেকিং নিউজ এটাই- ‘শিল্প-সাহিত্যের নগরী প্যারিস ‘আইএস’ নামক জীবাণুর কামড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে।’ এই জীবাণু নাকি পরীক্ষাগারেই জন্মলাভ করা, বড় হতে হতে পরীক্ষাগারের দরজা-জানালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। দ্রুত বিস্তার লাভ করে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। দুষ্টু লোকেরা বলে আমেরিকার দুধ-কলা খেয়ে বড় হওয়া এই জীবাণুর আবিষ্কর্তাও নাকি আমেরিকা। তাই তো আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার হাতে ধরে ভাবছিলেন, তিনি কেন এই পুরস্কার পাইলেন। ভাবতে ব্যস্ত ছিলেন বলে টের পাননি বোধহয়, প্রতিবেশির বাড়িতে জীবাণুটা ঢুকে আঁচড়ে-কামড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে। নিজের ঘরের দরজা-জানালার ফাঁক-ফোকড় বন্ধ করবেন কি, সংরক্ষিত এন্টিবায়োটিক (এখনো মোড়ক উন্মোচিত হয়নি) হাতে নিয়ে ভেতরের নিশ্চিন্ত ভাবকে বলছেন, ‘আমাকে কামড়াবে না, কেননা ও তো আমার ‘পেইট’। আর কামড়াতে এলেও ভয় নেই, এন্টিবায়োটিক দিয়ে দেব।’ আর তাই বুঝি প্যারিস-হামলার ঠিক আগে আগেই জিএইট সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আমেরিকান অধিকর্তা এবিসি টিভির সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললেন, আমি বিশ্বাস করি না আইএস- এর বাড় আরো বেড়েছে। কিভাবে বাড়বে? আমরা সাফল্যের সাথে আইএস-কে কনটেইনড করছি যে!
একটা সময় ছিল, আমাদের গ্রাম-গঞ্জে ডাক্তার দেখা যেত কালে ভদ্রে। তখন কি আমরা চিকিৎসা পেতাম না? আলবৎ পেতাম। আমাদের হাতুড়ে ডাক্তাররাই পেনিসিলিন দিতেন দরাজ হাতে। ১৯২৮ সালে আবিষ্কৃত হওয়া পেনিসিলিন হচ্ছে এন্টিবায়োটিকের একটি গ্রুপ। অনেক জাতের ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে কাবু মানব জাতিকে আরাম দেওয়ার জন্য প্রথম যুগের ধন্বন্তরিদের রাজা এটি। এর পরে এমপিসিলিন এল ১৯৬১-তে, আরো কার্যকর ধন্বন্তরি হিসেবে। যত দিন গেছে, নানা পথে নানা উপায়ে এরকম ‘সিলিন’-দের দেখা আমরা পাচ্ছি।
যেখানে গণতন্ত্র নাই, সেখানে ‘সিলিন’ প্রয়োজন। এক কালে সমাজতন্ত্র ছিল এক তীব্র ব্যথার নাম। আফগানিস্তানে সোভিয়েতপন্থী নূর মোহাম্মদ তারাকির সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর ‘আধুনিক আফগানিস্তান’ গড়ে তোলার প্রয়োজনে ব্যাপক ধড়পাকড় আর খুনখারাবি শুরু হল। শুরু হল তারাকির বিরুদ্ধে অসন্তোষ। বেকায়দায় পড়ে যাওয়া তারাকির ব্যথায় সমব্যথী হয়ে সেই ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ‘সিলিন’ এ্যাকশন শুরু করেছিল। এর রিয়াকশন নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছে যাওয়া চৌত্রিশটা দেশের বিশিষ্ট চিকিৎসকদের বোর্ড তারাকি বিদ্রোহীদের হাতে আমেরিকান আর আরব দেশসমূহের তেলসমৃদ্ধ অর্থে কেনা ব্যাপক ‘ফার্স্ট এইড’ তুলে দিয়ে, পাকিস্তান আর চীনে বিশেষ ‘মেডিকেল প্রশিক্ষণ’-এর মাধ্যমে গড়ে তুলল মর্দে জিহাদি ‘মুজাহেদিন’। এ্যাকশন-রিয়্যাকশনের যাঁতাকলে চিঁড়ে চ্যাপটা হওয়া বেচারা আফগানদের কোন উপায় রইল না, প্রায় দেড় মিলিয়নকে মরতে হল আর কয়েক মিলিয়নকে হতে হল রিফিউজি। ’৯১-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়াকেও ‘সিলিন’ রিয়্যাকশন হজম করে টুকরো টুকরো হতে হ’ল। পৃথিবী মোটামুটিভাবে সমাজতন্ত্র নামক ব্যথা থেকে মুক্ত হলেও ‘জিহাদি জোশ’ নামক ধারাবাহিক ব্যথায় আক্রান্ত হল। পরবর্তীকালে বিশিষ্ট চিকিৎসা-পরিভাষায় এর অর্থ দাঁড়াল জঙ্গিবাদ। ‘মুজাহিদ’ শব্দটা জঙ্গিবাদের ঘাড়ে ভর করে আফগানিস্তান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানান দেশে। ডাক নামও পেয়ে গেছে সময়ের ফেরে, আল কায়দা, তালেবান, বোকো হারাম, আইএস ইত্যাদি।
সত্যি বলতে কি, নির্বাক পৃথিবীতে মানব জাতির কাজ কিন্তু একটাই, ব্যথা উপশম। কাজেই ব্যথা পুরোপুরি উপশমিত হয়ে গেলে মানব জাতির আর কোন কাজ থাকবে না। তাই, ব্যথা সেরে যাবে, এ হবে না। মুজাহিদ নামক গোঁদ ফোঁড়া সময় বুঝে পাকে, ফেলে, পুঁজ গ্যাজায়। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলা ‘সিলিন’ এখন আধুনিক। পেটের ব্যথা সেরে গেল বলে দু’ রাকাত নফল নামাজ পড়ে সিজদা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে টের পাইয়ে দেয়, হাঁটুর ব্যথা শুরু হয়েছে। দরকার নতুন ‘সিলিন’। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারও একটা বিষয় বটে। ডাক্তারের মতি গতিতে যদি ভেজাল থাকে, তবে সঠিক ‘সিলিন’ পড়বে না, দিচ্ছি, দেব করে অকার্যকর ‘সিলিন’ দেবে আসলটা না দিয়ে, চিনিভরা হোমিওপ্যাথির পুরিয়া যেমন খেতাম ছোট বেলায়। তাই কোন্ ‘সিলিন’ লাগবে, তা না ভেবে আসল মানুষ খুঁজতে যেমন ব্যতিব্যস্ত হই, তার চেয়ে উদগ্রীব হতে হবে আসল ডাক্তার নিয়ে। কখনো কখনো মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে হয়, সেখানেও ঠিক ডাক্তারদের ঠাঁই যদি না হয়, তবে বোর্ড সঠিক চিকিৎসার পথ দেখাতে পারবে, এ ভরসাও বাতুলতা মাত্র।
কথা হচ্ছিল মার্কিন-ইজরায়েল-সৌদি-তুর্কি চিকিৎসকদের মেডিকেল বোর্ডের ব্যর্থতা নিয়ে। কেননা, ব্যথার পর ব্যথা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ এই বোর্ড আর নাকি ব্যথা সারাতে পারছে না। সাম্প্রতিক ব্যথা আইএস ওরফে ইসলামিক স্টেট ওরফে দায়েশ বিশ্বজুড়ে ব্যথা ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে মানব জাতি থর থর কম্পমান ছিল। বার বার বলেছি, তারস্বরে বলেছি, কাতর কণ্ঠে অনুনয়-বিনয় করে বলেছি, ওহে মার্কিন গং-বোর্ড, তোমরা যুতসই ‘সিলিন’ দাও, ব্যথা সারাও। খুব দামি এন্টিবায়োটিক লাগবে বলে ফান্ডও তৈরি করা হ’ল এই বোর্ডের নেতৃত্বে। এরপরও দিচ্ছি, দেব বলে আসল ‘সিলিন’ দেওয়া হচ্ছিল না, এ জাতীয় সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছিল। ব্যথার চোটে হাজার হাজার রিফিউজি ছুটল ইউরোপ মুখে, ব্যথা না সারতে পার রিফিউজিদের ঘরে তোল- এই দাবিও দাঁড়িয়ে গেল। মেডিকেল বোর্ডের অবস্থা তখন সত্যিই কেরাসিন। তুরস্কের সমুদ্রতটে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা তিন বছরের শিশু আয়লান কুর্দি বিশাল একখানা প্রশ্ন ঝুলিয়ে দিল স্বর্গ থেকে- এবার তোর কি হবে রে কালিয়া?
ভূ-রাজনৈতিক কূটচালে বিপর্যস্ত মানবতার ব্যথা তখন এরকম, শিশুদের যখন এভাবে মরতে হয়, নিরীহ মানুষের যখন বেঁচে থাকার সামান্য নিশ্চয়তা থাকে না, বাপ-দাদার ভিটেমাটির মায়া অর্থহীন হয় মুহূর্তেই, তখন আর ‘সিলিন’-জাদু দেখার ধৈর্য্য থাকে কি? বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন স্বীকার করে নেন, তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট বুশ-ই আইএস উত্থানের জন্য দায়ী, আইএস-এর হাতে যখন মার্কিন লেবেল লাগানো মারণাস্ত্র শোভা পায়, মার্কিন প্রশিক্ষণে বেপরোয়া হয়ে ওঠা আইএস দমনে মার্কিনী তৎপরতা আইওয়াশের মত মনে হতে থাকে, তখন? অধৈর্য্য মানবজাতির নতুন এই ব্যথা উপশমে আবির্ভূত হলেন পাল্টা ঘরানার পুরনো চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত নতুন মেডিকেল বোর্ড। রাশিয়া-চীন-ইরান-সিরিয়া-হিজবুল্লাহ চিকিৎসকদের বোর্ড যে ‘সিলিন’ দিয়েছে, তা নাকি ব্যথার একেবারে গোড়ায় আঘাত হেনেছে। পুঁজ পেকে ঢোল হয়ে যাওয়া জায়গায় কাঁতরাচ্ছে গোদা গোদা আইএস জীবাণু। হকচকিয়ে যাওয়া মার্কিন বিমান ভুল করে গোত্তা খেয়ে বসেছে আফগানিস্তানের এক হাসপাতালে আর সৌদি বিমান ইয়েমেনের এক বিয়ে বাড়িতে।
জঙ্গি যেখানে খুঁজবে, সেখানে না খুঁজে ওরা কেন ভুল জায়গায় খোঁচা মারছে? এ যেন সেই কৃষকের হাল, গরু হারালে স্ত্রীকে-ও ভুল করে মা ডেকে বসে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি হবে আবার? নতুন ‘মুজাহিদ’ গড়ে তুলবে কি মার্কিন গং-বোর্ড? এই বোর্ডের কবজিতে জোর নাকি আগের মতো নেই। সার্জারি সুখকর হবে বলে নিজেরাই ভরসা পাচ্ছে না। আর সেজন্যই কি বয়ান এলো, আইএস কনটেইনড! বিষ দাঁত ফেলে দেওয়া সাপকে বাদ দিয়ে নতুন লাদেন আবিষ্কারে মন দিতে চাইছে মন, আর ঠিক তখনি শিল্প-সাহিত্যের নগরী প্যারিস ‘আইএস’ নামক জীবাণুর কামড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ল। আচ্ছা, জন্মদাতার অগোচরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হয়ে যায়নি তো দায়েশ?
ফরাসী প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘আমরাও আরো নির্মম হবো।’ খুব দামি প্রসঙ্গ। মাঠে নতুন ‘মুজাহিদ’ না নামিয়ে দায়েশকে দিয়েই নির্মমতার প্রতিযোগিতা শুরু হতে যাচ্ছে কি? প্যারিস-হামলার একই সময়ে লেবাননে হামলায় মারা পড়ল শত শত মানুষ, যদিও খবরের সন্ধানে ছুটে চলা কারোর পা ওদিকে পড়েনি। দায়েশ পৌঁছে গেছে প্যারিসতক, তার দু’দিন আগেই আমেরিকা রিফিউজিদের সহায়তার সামান্য চেষ্টাকেও গুডবাই জানিয়ে বলেছে, এদেরকে কোন দয়া দেখানো যাবে না। কেননা, এরা ‘রিফিউজি’ না ‘দায়েশ’ তা আমরা বুঝতে পারছি না। আর এই প্রশ্নকে আপাদমস্তক সমর্থন করে দায়েশ মৃত্যুর উৎসব করল প্যারিসে। এর ফলে আমেরিকান প্রশ্ন আন্তর্জাতিক মানে উপনীত হল।
এই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার। সাগর তীরে মুখ থুবড়ে থাকা আয়লান আর চোখে পানি আনতে পারবে না। কেননা, ও ‘রিফিউজি’-র ছদ্মবেশে জঙ্গি। এরকম চার হাজার জঙ্গি নাকি ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ জুড়ে। আর আইএস বা দায়েশ বা জঙ্গি খুঁজতে গিয়ে ওরা মারবে কাকে? রিফিউজি না কি মুসলমান না মানুষকে? বিশ্বজুড়ে মুসলমান এখন টার্গেট হওয়ার অপেক্ষায়, মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসী আইএস-এর বন্দুক তাক হচ্ছে রিফিউজি তথা মুসলমান তথা মানুষের দিকেই, যদিও ট্রিগারে হাত অন্য কারোর। বুঝতে পারছি, মানবতা এখন সরাসরি তোপের মুখে। কে কোথাকার মানুষ, রিফিউজি কি দায়েশ, এশিয়ান কি ইউরোপিয়ান, ধার্মিক কি অধার্মিক, এসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে কে মানুষ আর কে মানুষ না, সে প্রশ্ন তুলে ধরার সময় কি এখনো আসেনি?
মানবতার সত্যিকারের ব্যথাটা আসলে কি, তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। সত্যিকারের ব্যথার জন্য চাই সত্যিকারের ডাক্তার, যার হাতে আছে সত্যিকারের ‘সিলিন’। অপারেশনের পর পেটের ভেতর ছুরি-কাঁচি রেখে সেলাই করে দেওয়া ডাক্তার নয়, ঘুমের ঔষুধ দিতে দিতে পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসনকে মেরে ফেলা ড. কনরাড মুর্যে, রোগির লাইপোস্যাকশন করতে করতে অপারেশন টেবিলে ঘুমিয়ে পড়া ড. এন্ড্রু হল্টনও নয়-গুগল সার্চে সর্বকালের সবচেয়ে বাজে ডাক্তারদের তালিকা পাওয়া যায়, সেখানে জায়গা করে নিতে পারা ডাক্তারদের থেকে শত হাত দূরে থেকে বিনা চিকিৎসায় মরি, তা-ও ভাল।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক।
এইচআর/এমএস