ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

২০২১ হোক জীবন আর বিজ্ঞানের জয়গান

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান | প্রকাশিত: ০১:০৬ এএম, ০১ জানুয়ারি ২০২১

নীল নদে নতুন বছর

২০২০ এর শুরুটা ছিল বর্ণাঢ্য এবং মনে রাখবার মতো একটি চমৎকার স্মৃতি। আসওয়ান থেকে সূর্যাস্ত দেখে নীল নদের ওপর আমাদের জাহাজ লাক্সরের দিকে রওনা হলো। রাজসিক এক নৈশভোজের পর গান, নাচ আর আলোর মায়াবী ছটায় মধ্যরাত থেকে শুরু হলো নতুন বছরকে বরণের উৎসব।

বছরের প্রথম দিন খুব ভোরে আমরা একটি ছোট প্লেনে করে রওনা হলাম আবু সিম্বলের দিকে। তিন হাজার বছরেরও আগে রাজা রামসে তার দেবতা আমুনের জন্য তৈরি করেছিল এ দেবালয়।

এ রকম একটি অসাধারণ নববর্ষের উদযাপন করে বাড়ি ফিরেছিলাম অনবদ্য একটি নতুন বছরের জন্য।

কালো অধ্যায়ের শুরু

অরল্যান্ডে ফিরে আসার পরই করোনাভাইরাসের খবরটা জানলাম। একটি নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাস। তখনো কেবল চীনেই সীমাবদ্ধ। সেটি যে মহামারি হয়ে অতিমারি হয়ে যাবে কল্পনাতেও ভাবিনি আমরা।

বাহামার হাতছানি

ফেব্রুয়ারিতে বিশাল এক ক্রুজশিপে করে আমাদের মেডিকেল কলেজের অ্যালামনাইদের এক অভূতপূর্ব মিলনমেলায় আমরা বাহামা দ্বীপপুঞ্জের দিকে রওনা হলাম। সে মিলনমেলা ছিল অসাধারণ! ক্যারিবিয়ান সাগরের নীলজল আর মোহনীয় সব দ্বীপে আমরা কাটিয়েছিলাম স্বপ্নময় মুহূর্তগুলো।

jagonews24

করোনাভাইরাস তখনো এখানে এসে পৌঁছেনি। আমরা আনন্দের জেয়ারে ভাসতে ভাসতে মিলনমেলার ইতি টানলাম।

আমাদের দুঃস্বপ্নের শুরু

ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে টনক নড়লো। করোনাভাইরাস আস্তে আস্তে গ্রাস করছে দেশের পর দেশ, মহাদেশের পর দেশ।
মহামারি কিংবা অতিমারির গল্প পড়েছি। কখনো ভাবিনি এর অংশ হয়ে যাব। দুঃস্বপ্নের শুরু হলো ওয়াশিংটন স্টেটে। তারপর নিউইয়র্কে .... তারপর সব জায়গায়।

বন্ধু হারাবার বেদনা কেবল প্রথম অধ্যায়

তখনো আমরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। এর লক্ষণ, চিকিৎসা, বিস্তার কিছুই জানা ছিল না আমাদের। আমার খুব কাছের বন্ধু লন্ডনে কর্মরত ইউরোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল মাবুদ চৌধুরী ফয়সালের করোনার লক্ষণটা ছিল ভিন্ন ধরনের। তখনো আমরা জানিনি এই ভাইরাস শরীরের শ্বাসতন্ত্রকে নীরবে নষ্ট করে ফেলে। সারা শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে যায়। অথচ শরীর টের পায় না। যাকে আমরা বলেছি ‘হ্যাপি হাইপক্সিয়া’।

jagonews24

সারা শরীরে জীবনঘাতী প্রদাহ দখল করে নেয় বেঁচে থাকার সব পথ। অথচ ফয়সালের মতো প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একটি অসাধারণ মানুষ কাউকে বোঝার আগেই করোনা হিমশীতল ছোবলের কাছে হেরে গেল।

আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জীবন আর মৃত্যুর সমীকরণটা বড় অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল। হঠাৎ করে পরিচিত জগৎটা বদলে গেল। ‘লকডাউন’ শুরু হলো লোকালয়ের পর লোকালয়। থমকে গেল সবকিছু।

শুরু হলো মৃত্যুর মিছিল। একের পর এক পরিচিত মুখগুলো ঝরে যেতে শুরু করলো। একের পর এক হাসপাতালগুলো ভরে যেতে শুরু করলো। লাশ রাখার জায়গা হলো না। একটি দুঃস্বপ্নের শুরু হলো। বুঝলাম আমিও হতে পারি ওদের মতো যেকোনো সময়। বদ্ধ বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরে অনুধাবন করলাম, আমাদের লড়তে হবে।

রুখে দাঁড়াবার সময়

অতিমারির এ সময়ে একজন চিকিৎসক হিসেবে বন্ধু-স্বজন হারাবার বেদনা বুকে নিয়ে আমরা দাঁডিয়ে গেলাম পরিচিত জনপদের সবাইকে সাহায্য করবার জন্য। নিজের কমিউনিটির জন্য ফুডব্যাংক, হেল্পলাইন, মাস্ক সরবরাহ দিয়ে শুরু হলো। এরপর এখানের এবং বাংলাদেশের চিকিৎসক ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনরাত ওয়েবিনার, জুম মিটিং, টেলিভিশন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরামহীন আলোচনা, সাহায্যের জন্য রাতারাতি ফান্ড কালেকশন চলতে থাকলো।

সারাবিশ্বের ছড়িয়ে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, গবেষকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন কীভাবে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশিদের সাহায্য করা যায়। আমরা সবাই মিলে রাতারাতি প্রথম সারির চিকিৎসকরা কীভাবে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করবেন তা নিয়ে দুটো বই বের করে ফেললাম।

jagonews24

কেবল আমাদের আমেরিকার চট্টগাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা চট্টগ্রামের অক্সিজেন সংকট মোকাবিলায় রাতারাতি এক কোটিরও বেশি টাকা তুলে ফেললো। এটি কেবল একটি ছোট উদাহরণ।

এ অতিমারিকে নিয়েই আমরা দেখলাম অতিমানবীয় সব কাজ। অবশ্য এর পাশাপাশি দেখেছি পৈশাচিক হীনমন্যতা। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবতা আর বিজ্ঞান।

অবশেষে নিজেও

আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আক্রান্ত হলো কোভিডে। আমারও শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল। এখনো প্রশ্ন করি কীভাবে? করোনা সম্পর্কে এত সাবধানতার পরও এটা পেয়ে বসলো আমাকে। সবার ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ, কৃতজ্ঞ। এসব শোধ করা যায় না। তবে বুঝি আরও অনেকদিন বেঁচে থাকতে হবে এ ঋণ পরিশোধের জন্য।

নতুন দিগন্তের বন্দনা

করোনার নতুন মিউটেশন হচ্ছে। সংক্রমণের হার বাড়ছে। মৃত্যুর হার বাড়ছে রেকর্ড পরিমাণ। কিন্তু আমরাও তো বসে নেই। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা থেমে নেই। এসেছে নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, বায়োলজিক চিকিৎসা। এসে গেছে তিন তিনটি ভ্যাকসিন। আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

এই অতিমারির মৃত্যু উপত্যকায় সূর্য উঠবেই।

নতুন বছর নিয়ে আসুক নতুন আশা।
জয় হোক মানবতার আর বিজ্ঞানের।

এইচআর/বিএ/এআরএ