সবার আগে দেশ
ডিসেম্বর মাস বাঙালির বিজয়ের মাস। এই মাসটা এলেই মনে করিয়ে দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, কত বীরত্ব ও অসামান্য আত্মত্যাগের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের এই মাসটিকে আমরা বড় আবেগের আনন্দ ও বেদনা নিয়ে উদযাপন করি। এই দিনটি দেশ এবং জাতির জন্য গৌরবের দিন। আনন্দ বিজয়ে, বেদনা লাখো শহীদের আত্মদান আর রক্তের স্রোতের কারণে। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের প্রাণে গর্ব ও গৌরবের বাঁশি বাজায়। কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ কতটা সর্বজনীন সোনার বাংলাদেশ হতে পেরেছে তা আমাদের ভাবনায় খুব কমই আসে।
একবারও কি ভেবে দেখেছি যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটা অগ্রসর হয়েছে? একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সার্বিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কতটা ফারাক রয়েছে? নাকি আদৌ কোন ফারাক নেই! বিষয়টি তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার দিকে তাকাই। দেখতে পাই- উচ্চবিত্ত, শ্রেণি বিশেষ এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ভাগ্যই কেবল উন্নতির দিকে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নিম্নবিত্ত তথা কৃষক-শ্রমিক ও কারিগর শ্রেণির মানুষের ভাগ্যে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি দেশের সাধারণ মানুষের। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত তাদের একমুঠো ভাত যোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই! সর্বদা সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সূচক পূরণে যতটা এগিয়ে যাচ্ছেতার চেয়ে সুবিধাভোগীরাই বেশি সমৃদ্ধি লাভ করছে।
সুবিধাভোগীরা বাঙালী, আর বঞ্চিতরাও বাঙালী। আর এই অর্জন কেবলমাত্র শ্রেণি বিশেষের জন্যই যুদ্ধে অর্জিত বিজয় তা প্রমাণ করে দিয়েছে। স্বাধীনতা তথা বিজয়ের মাস নিয়ে গর্ব কি শুধু সমৃদ্ধ শ্রেণির জন্যই? সমাজ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতেই থাকবে? তবে কি এই অবস্থা থেকে এদেশের সাধারণ মানুষ রেহাই পাবে না? এ প্রশ্ন আজ সমাজের সচেতন ও বিবেকবান সব মানুষের।
পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি - নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে। একটি গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়েই বীর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সা, অপরাজনীতি ও অহমিকার কারণে আমাদের স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তির প্রাক্কালে বলতে হয় সে প্রত্যাশা এখনও পরিপূর্ণ পূরণ হয়নি; বরং অর্জন যৎসামান্যই বলতে হবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তির প্রক্কালে বলতে হয় এ দীর্ঘ সময়ে আরও অনেক উন্নয়ন হবার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। বিগত বছরগুলোতে স্বনির্ভরতা, সোনার বাংলা, দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য শিক্ষা, একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইত্যাদি নানান ধরনের কর্মসূচি গৃহীত হলেও ৪৯ বছরে বাংলাদেশের অর্জন আশানুরূপ নয়। এই জন্য একদিকে যেমন জনসংখ্যার আধিক্য, শিক্ষার অভাব, দাতাদেশ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কঠিন শর্ত আরোপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী; অন্যদিকে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়।
স্বাধীনতার সুফল অর্জন ও তা জনগণের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিতে হলে এসব সমস্যার সমাধানে সকলকে বিশেষভাবে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে আমাদের প্রত্যাশিত উন্নতি অর্জিত হচ্ছে না কেন? এসবের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করতে হবে। দেশে কল্যাণকামী সকলকে, সকল রাজনৈতিক দলকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে। কথায় ও কাজে এক হতে হবে। তবেই হবে দেশের উন্নতি, তবেই হবে দেশের কল্যাণ।
যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার মহান বিজয় দিবসের অন্যতম প্রত্যয়। প্রত্যাশা করি আগামী সুবর্ণ জয়ন্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় ঐক্য। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্য।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন।
এইচআর/এমকেএইচ