ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জিতবে তো আওয়ামী লীগ?
মৌলবাদী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠি আওয়ামী লীগ সরকারকে এক কঠোর পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই পরীক্ষায় অবশ্য সরকার যে পড়বে সেটা বহুকাল আগে থেকেই উদারপন্থীরা বলে আসছিলেন। যারা মোটামুটি আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে আছে কিছুটা অভিমানে বা কিছুটা অবহেলা পেয়ে। আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে জামায়াত ইসলামকে বাদ দিয়েছে, অন্যদিকে কট্টরপন্থী হেফাজত ইসলামকে বুকে টেনে নিয়েছে। যারা রাজনৈতিক দল না হয়েও জামায়াতের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং পদে পদে বর্তমান সরকারকে ভোগাচ্ছে।
একটা সময়ে সরকার কট্টর ধর্মীয় নেতাদের প্রায় অনেক দাবিই মেনে নিয়েছিলেন। নিয়েছিলেন হয়তো ক্ষমতার স্বার্থে। হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে সরকার আপোস করেছিল। কিন্তু এখানে বিষয়টা মনে হচ্ছে আরো জটিল। যারা ভাস্কর্যর বিরোধিতা করছে, তারা তাদের বিরোধিতাকে ধর্মীয় ভিত্তি দিয়েছে। আপোসের জায়গাটা সেখানে ক্ষীণ। সরকারের পক্ষেও আপোসের রাস্তা প্রায় বন্ধ। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য সরানোর দাবি মানা কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়? যে হেফাজত ও তাদের অনুসারীদের সরকার নানা কিছু দিয়ে চুপ রাখার চেষ্টা করেছিল তারাই এখন সরকারের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। ধর্মকে তারা ব্যবহার করতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুদার ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। এরা ফতোয়া দিয়েছে, তাদের দৃষ্টিতে ভাস্কর্য আর মূতি একই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের আয়োজনে শনিবার এক বৈঠকের কথা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। সেখান থেকে দেয়া এক বিবৃতিকে বলা হয়েছে, ‘মানবমূর্তি ও ভাস্কর্য যে কোন উদ্দেশ্যে তৈরি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।’ তারা বলেছেন, ‘এমনকি কোন মহৎ ব্যক্তি ও নেতাকে মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানানো শরিয়ত সম্মত নয়’। অথচ এই মৌলবাদীরা যে দেশগুলোকে ইসলামের আদর্শ রাষ্ট্র মনে করে তার মধ্যে অন্যতম সৌদি আরবতো কট্টর পন্থা থেকে সরে এসে এখন ইহুদি নাসারদের স্বার্থে চুক্তি করছে। আবার তুরস্ক মুজিববর্ষ উপলক্ষে রাজধানী আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাজধানী ঢাকাতে কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য স্থাপনের ঘোষণা দিল। শুধু তাই নয়, ইস্তাম্বুল ও চট্টগ্রামেও এই ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে। উপরন্তু বাংলাদেশ কোনো ইসলামী রাষ্ট্র নয়। এর একটি সংবিধান রয়েছে। এটি ইসলামী শরিয়ামতো চলে তেমনটা নয়।
তাহলে কি এটা ভাবতে হবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হওয়ার পথে এগুচ্ছে। এখানে এসে গেঁড়ে বসেছে কট্টরপন্থা। যদি তাই হয়ে থাকে তবে তার দায়ও কিন্তু বর্তমান সরকারকে নিতে হবে। কিন্তু একথাও ভাবতে কষ্ট লাগে এমন একটি দল ক্ষমতায় যারা স্বপ্ন দেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ গড়ার। যারা স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের রোল মডেল হবে। কিন্তু ঘরের ভেতরে ঘর বা সরকারের ভেতরে সরকার থেকে মৌলবাদীরা যে প্রশ্রয় পেয়ে আসছে তাতে ধীরে ধীরে তারা বিষবৃক্ষ হয় উঠছে। হেফাজতের সভাপতি আহমদ শফী তার এক বক্তব্যে নারীদের পঞ্চমশ্রেণির বেশি পড়াতে নিষেধ করেছিলেন। নারীদের তেঁতুলের সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন। আবার এই হেফাজতে ইসলামের দাবিতে আমাদের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রগতিশীল ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লেখকদের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়।মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। ইউনেস্কো বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েও আহমদ শফী ও হেফাজতে ইসলামের আপত্তির শেষ নেই। এগুলো কি প্রশ্রয় নয়? এরা প্রতিনিয়ত বক্তব্যে আলোচনায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্য ধর্মকে হেয় করে চলছে। তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে? অথচ রীতা দেওয়ান পালা গানের বাক যুদ্ধে কী বললেন তা নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড।
আসলে বাংলাদেশে মৌলবাদীরা আস্কারা পেয়ে পেয়ে এখন সহিংস ধর্ম সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পাকিস্তান ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তখন কথা উঠেছিল সেই রাষ্ট্রটি কেমন হবে? তা কি পাকিস্তানের আদলে হবে? এই রাষ্ট্রের মানুষ কি পাকিস্তানের মতো আচার আচরণ করবে? অন্য ধর্মাবলম্বী জনগণ কি পাকিস্তানের মতো শোষিত ও নিপীড়িত হবে? তখন বঙ্গবন্ধু চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখালেন। এই চার মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। এই চার নীতির ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দাবিদার বর্তমান সরকার অনেকটা প্রকাশ্যে এই ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে আসছে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে পবিত্র ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে কী জুয়োচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার এই বাংলার মাটিতে চলেছে। ধর্ম পবিত্র। পবিত্র স্থানে রাখতে দেন। একে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। এখানে যদি কেউ আমাদের বলেন আমরা অধিকার খর্ব করেছি, অধিকার খর্ব করি নাই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য এই অধিকারটুকু আমাদের খর্ব করতে হয়েছে।’
তাহলে সমস্যাটা শুরু হলো কোথায়? যখন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলো। ধর্মকে ক্ষমতায় আসার পথ হিসেবে দেখা শুরু হলো। ধর্ম ব্যবসায়ীরা আস্কারা পেতে পেতে ক্ষমতার স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে উঠলো এবং একইসঙ্গে বিরুদ্ধ মত দমনে তাদের ব্যবহার করা হলো। তখনই বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ধর্মান্ধতা। তারা তখন স্লোগান দিতে থাকলো, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। আমরা সরে গেলাম সেই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও শ্যামল গুপ্তের সুর করা গানটি থেকে। তিনি লিখেছেন,
‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ,
বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান,
আমরা সবাই বাঙালি।’
আমরা আর বাঙালি রইলাম না। আমাদের পরিচয় হতে লাগলো ধর্মীয় ভিত্তিতে। কারণ একথা কে না জানে, বাঙালি-বাঙালি ভাই-ভাই না হয়ে, যখন শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে কেউ কারো ভাই হয় তবে সার্থকতা পায় ধর্মীয় মৌলবাদীরা। মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা না করে, অন্য ধর্মকে সন্মান করতে না শেখে, শুধুমাত্র নিজেকে সবার সেরা প্রমাণে সচেষ্ট হয়ে উঠে তাহলে সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠবে না।‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ তাই এখন নিছক একট আপ্তবাক্য। বড় বড় অফিস আদালত থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি, যারা নিজেকে অনেক বড় প্রগতিবাদী বলে পরিচয় দেন তারা ভেতরে ভেতরে মৌলবাদকে লালন করেন। অন্য ধর্মের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। আচরণে সেটা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেন না।
তাহলে সমাধান, এই যে শনিবার থেকে শুরু করে জেগে উঠতে শুরু করেছে পুরো বাংলা। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। মৌলবাদীরা যেন কোথাও দাঁড়াতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যে দেখা গেছে শাহবাগ, টিএসসিও জাগছে। কিন্তু অতীতে আমরা প্রয়োজন শেষে তাদের ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি। কিন্তু শত লাঞ্ছনার পরও তারাই আবার রাজপথে এসে দাঁড়ায়। তারাই আবার দেশটাকে বাঁচানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। এর সাথে সরকারকেও যুক্ত হতে হবে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন যাদের নামে পাড়ায় পাড়ায় চাঁদাবাজি আর মাস্তানির অভিযোগে জেরবার হওয়ার দশা, তাদেরও এখন কাজে লাগানোর, মাঠে নামানোর উত্তম সময়। আর ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের মনে রাখতে হবে যে, হুমকি বা হুশিঁয়ারিতে এখন কাজ হবে না। প্রয়োজন সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলা। মৌলবাদীরা জিতলে এই দেশ পিছিয়ে যাবে হাজার বছর। তার থেকে উত্তরণের সহজ পথ আর থাকবে না। যেমনটি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের দিকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি। সরকার নিশ্চয় চাইবে না এমন দেশটিকে পেছনে ফেলে মৌলবাদীদের জয় জয়কার দেখতে। তাই এই কঠিন সময়ের পরীক্ষায় জয় পেতে হবে আওয়ামী লীগকে, সরকারকে, শেখের বেটিকে।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/এমকেএইচ