ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জাপানে করোনায় মৃত দুই হাজার, আত্মহত্যা সতের হাজার!

তানজীনা ইয়াসমিন | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২০

যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রবণতায় যে কোন প্রাণ বাঁচার আশা করে। তাই পরিস্থিতি যেমনই হোক কোনো একটা পরিত্রাণের উপায় অবশ্যই থাকে। তবে দুঃসময়ের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হলো সর্বজনীনতা। সুসময়েও সর্বজনীনতা থাকে, তবে তাতে থাকে প্রতিযোগিতা। “আমি এই এই ভাবে তোমার চেয়েও ভালো আছি, সুখে আছি, শ্রেয় আছি” । দুঃখের সময়ে কেউ যদি প্রতিযোগিতা করে নিজের দুঃখকে অপরের চেয়ে বড় করে বলে মহান হতে চান তো তিনি সেই সময়ে কেবল করুণাই কুড়ান , তারিফ বা বিস্মিত নজর না।

আজ দৃশ্যমান মহাশক্তি যা পারেনি অদৃশ্য এক ভাইরাস এক অতিমারির বলয়ে গোটা পৃথিবীকে সেই এক কাতারে এনে দিয়েছে। অপরদিকে সীমানা করে দিয়েছে অবরুদ্ধ। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক আগ্রাসী দেশগুলো যেখানে বিপর্যস্ত, সেখানে ভুটান, ভিয়েতনামের মতো দেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের সাথে অতি সংশ্লিষ্ট দেশ জাপান। জাপানের বর্তমান জনগণের ১০ শতাংশ চৈনিক ইমিগ্রেন্ট। তাই মোটামুটি জানুয়ারি থেকেই জাপানে করোনার তোড়জোর। তথাপি এখন পর্যন্ত দেশটিতে কোভিট ১৯ এ মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছুঁয়েছে। শনাক্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১ লক্ষ ৬৩ হাজার। এক্ষেত্রে অনুল্লেখ্য হলেও জাপানে বসবাসকারী বা ভ্রমণকারীরা জানেন, জাপানে পলেন এলার্জী , শীতকালীন ফ্লুয়ের আনাগোনা এবং হলুদ ধুলা ( বা এশিয়ান ডাস্ট) এর আতংকে বহু জাপানিই বছরের একটা বড় সময় মাস্ক পরেই থাকেন। ২০০৩ এ সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবও এ অভ্যাস জোরদার করেছে এবং এই প্রচলিত অভ্যাসই শুরু থেকে করোনা রোধে খুব কাজে এসেছে।

এছাড়া জাপানীরা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, নিয়মানুবর্তি ও শৃঙ্খলিত হিসেবেই বিশ্বে সুপরিচিত। কাজেই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আরোপিত স্বাস্থ্যবিধি এরা আপাতভাবে খুব সহজেই মেনে চলেছে। কোথাওই বেত্রাঘাত বা জেল জরিমানার প্রয়োজন হয়নি। স্কুল কলেজ দুই মাস বন্ধ ছিল, অফিস আদালতও দুই মাস হোম অফিসে পড়েছে। কিন্তু জুন থেকেই সব খুলে গিয়েছে। ইউনিভার্সিটির ক্লাস এখনো অনলাইনে হলেও ল্যাব, থিসিস ওয়ার্ক, বিভিন্ন খেলার সার্কেলে কার্যক্রম দ্রুতই নিয়মিত হয়ে গেছে।

তবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি মূল্যবোধের সাথে কিছু সংস্কারও থাকে। জাপান সেই আদিকাল থেকেই অবরুদ্ধ এক দেশ। তাই দেশে দেশে সীমানা যখন কোভিডের আঘাতে অবরুদ্ধ হলো, জাপানও তেমনি তার সীমানা বন্ধ করে দিলো। এখনো অবধি রাজধানী টোকিও ও প্রাক্তন রাজধানীর কানসাই রিজিওন ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট প্রায় নেই। সীমিত এয়ারলাইন্স আর সীমিত রুটের ফ্লাইটে টিকেটের চওড়া দাম ছাড়াও আছে ট্রাভেলের জন্য করোনা টেস্টের আকাশচুম্বি দাম, জনপ্রতি বাংলাদেশি মূল্যে ৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও অন্য কোনো দেশ থেকে জাপানে যেতে হলে লাগবে উক্ত দেশের জাপান অ্যাম্বাসিতে বার কয়েক ধর্না দিয়ে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অনুমতি অর্জন। এসব মহা ঝক্কির কারণ একেবারে ইমার্জেন্সি বা অনন্যোপায় না হলে যেন কেউ জাপানে প্রবেশের বা জাপান থেকে ট্রাভেলের জন্য যেন বাইরে যাবার চেষ্টা না করে।
তথাপি, জাপানের একটি অতি নিজস্ব সমস্যা ঠিকই এই অতিমারিতে ট্রিগার করেছে।

আত্মহত্যা প্রবণতায় বিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী জাপানে এই অতিমারিতে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার না গড়াতেও অতিমারিজনিত হতাশায় আত্মহত্যা করেছে ১৭ হাজারের বেশি। অতিমারিতে মৃত্যু না হলেও অতিমারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়াই এর সম্ভাব্য কারণ। জাতীয় পুলিশ এজেন্সি থেকে অস্থায়ী পরিসংখ্যান দেখায় যে কেবলমাত্র অক্টোবরে আত্মহত্যার হারে বেড়েছে ২১৫৩ জন, যা ক্রমাগত এই আত্মহত্যা বৃদ্ধির চতুর্থ মাস হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এবং এই পরিসংখ্যানে নারী আত্মহত্যার ঘটনা হয়েছে মোট এক তৃতীয়াংশ, বেড়েছে ৮০% এরও বেশি।

শিশুদের যত্ন নেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্বে থাকা মহিলারা মহামারি-প্ররোচিত কাজের ক্ষতি এবং নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়েছেন। তারা ঘরোয়া সহিংসতারও বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, যা সহায়তা কেন্দ্রগুলি বলছে যে সারা বিশ্ব জুড়ে যেমন এই বছর বেড়েছে জাপানেও তেমনি ঘরোয়া সহিংসতা আরও খারাপ হয়েছে। এমনকি শিশুদের আত্মহত্যার পরিমাণ, যদিও তা মোটের খুব ছোট একটি অংশ, তবুও এটিও বেড়েছে ।

এর কারণ, জাপান সুপ্রাচীন কাল থেকেই তাদের সংস্কার বা মূল্যবোধ এবং মানসিক অনুষদে উচ্চ আত্মহত্যার হার নিয়েই চলে এসেছে। চির অবরুদ্ধ এক দ্বীপদেশ জাপানে ষোড়শ শতকে মিশনারীদের আগমন ও তৎপর্তী ধর্মরক্ষার্থে বা খ্রিস্ট ধর্মের আগ্রাসন ঠেকাতে রক্তস্নাত আগ্রাসনের পর ২০০ বছর ছিল অবরুদ্ধ। ১৮৫৩ তে মার্কিন কমোডর মেথিউ পেরি টোকিও উপকূলে চারটি জাহাজ নোঙর করার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সাথে জাপানের যোগসূত্র স্থাপন করেন। তবু শতাব্দীকাল ধরে রক্তের ধারায়, মানসিকতা, মূল্যবোধে প্রবাহিত এই প্রবণতা যেকোন সামান্য হতাশা, চাপ, অসন্মান, দায়িত্বে গাফিলতির প্রমাণ বা ব্যর্থতাতেই সবচেয়ে প্রচলিত সমাধান। এই একই বদ্ধ সমাজ সংস্কৃতির অংশ “হিকিকোমরি” অর্থাৎ সামজিক প্রত্যাহার। নিজের ঘরের বা বাড়ির কোনো এক কোনে নিজেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা। কিশোর থেকে তরুণ যুবকদের এই প্রবণতা খুব প্রতুল, যেটা স্কুলে বা বন্ধু মহলে বুলি বা শিক্ষকের তিরস্কার থেকে ল্যাবে ব্যর্থতা কিংবা কর্মক্ষেত্রের চাপে সাধারণত ট্রিগার করে।

সম্ভবত করোনাকালের প্রারম্ভে প্রাথমিকভাবে "আমরা সকলেই একসাথে এই মহামারিতে” এই স্লোগানে, জুলাই মাসে কার্যক্রম ঘুরে না যাওয়া পর্যন্ত, আত্মহননের সামগ্রিক সংখ্যা নিম্নমুখীই ছিল । এরপরেই সামগ্রিক ইতিবাচকতা হ্রাস পেয়েছে এবং পাবলিক ভর্তুকির বাফারিং প্রভাবটি অদৃশ্য হয়ে গেছে।

অপরদিকে জাপানে ফ্লুয়ের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ অ্যাভিগান চায়নাতে করোনা রুগীদের জন্য সাফল্য এনে দিয়েছে বলে কোভিড সংক্রমণের শুরুতেই চায়নার বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউট দাবি করে এসেছিল। কিন্তু জাপান কখনোই তাতে সায় দেয়নি, বরং জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় এই এভিগান গুরুতর লক্ষণযুক্ত রুগীর ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। তারা দাবি করেন যে ৬০ থেকে ৮০ জনের উপর এই ড্রাগ প্রয়োগ করে তারা দেখেছে ভাইরাস যখন বহুগুণে বেড়ে যায় তখন এই ড্রাগ সফলকাম হয় না। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে এই ড্রাগের জন্য তখন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। তথাপি জাপান সরকার এই ড্রাগ কোভিডের ওষুধ হিসেবে ছাড়পত্র দেয়নি।
পরবর্তীতে ইউএস, ইউকে, জার্মান , রাশিয়া ভ্যাক্সিন উৎপাদনে এগিয়ে আসলেও জাপানে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কিছুটা পশ্চাতে। জাপানের বৃহত্তম ওষুধ প্রস্তুতকারক তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যাল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ড্রাগ বিকাশকারী- নোভাভ্যাক্স এবং মর্ডানার উৎপাদিত ভ্যাক্সিন আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরা করোনভাইরাস ভ্যাকসিন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া অ্যাঞ্জেস নামক ড্রাগ ভেঞ্চারকে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য জাপানের সরকার জরুরি অনুদান ও উন্নয়ন বাজেট দিয়েছে। তথাপি মেডিকেল গবেষণার জন্য জাপানের সরকারি বাজেট ( ২ বিলিয়ন ডলার) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম।

এই মুহূর্তে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাঞ্জেস ড্রাগ ভেঞ্চারের যৌথ উদ্যোগে ভ্যাক্সিনের প্রথম ক্লিনিক্লাল ট্রায়াল চলছে। অ্যাঞ্জেসের প্রতিষ্ঠাতা রুইচি মরিশিতা (গবেষক ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর) বলেছেন, প্রচলিত নিয়মে ভ্যাক্সিন প্রস্তুতে ৫ বছর সময় দরকার । কিন্তু আমরা কি এভাবে পাঁচ বছর বাঁচব?

এদিকে জাপান সরকারের প্রধান উদ্বেগ টোকিও অলিম্পিক, যা ২০২০ এ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি এবং ২০২১ এর জুলাইতে পিছিয়েছে, তা আদৌ সম্ভব কিনা। ইতিমধ্যে টোকিও অলিম্পিকের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি এবং কর্মসংস্থানের বিপুল ব্যয়ভারের ক্ষতিপূরণ কোভিডসৃষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে আরো ধরাশায়ী করেছে। সর্বোচ্চ গড় আয়ুর এই দেশের অন্যতম উদ্বেগ বয়োজ্যেষ্ঠর অত্যাধিক্য। করোনার ভাইরাসে উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকিতে থাকা এই বিপুল জনগোষ্ঠির জন্য সরকার প্রবল চাপ অনুভব করছে।

জাপানের বারো কোটি জনগণকে টার্গেট করে নির্মিতব্য বা সুরক্ষিত ড্রাগের কেবল ১ কোটি ভ্যাক্সিন ২০২১ এর প্রথম অর্ধাংশে প্রাপ্য হবার আশা। আদতেই গোটা বিশ্বের সাড়ে ৭ বিলিয়ন মানুষের জন্য ১৫ বিলিয়ন ডোজ গবেষণাসফল ভ্যাক্সিন প্রস্তুত, বাজারজাত এবং ট্রান্সপোর্টেশনের মত বিশাল লজিস্টিক প্রস্তুত খুব দ্রুত কি সত্যিই সম্ভব?

সূত্রঃ

১। https://www.cbsnews.com/news/japan-suicide-coronavirus-more-japanese-suicides-in-october-than-total-covid-deaths/?fbclid=IwAR2QBRnSP0hQUWk2A1v8gz76OUGBnfeSbpRGP2zDsOLaAPOlA6Uko6Tg1YU
২। https://www.cbsnews.com/news/coronavirus-there-is-hope-two-drugs-that-could-help-patients-fight-back/?fbclid=IwAR3pywK0eRpyCkJ7Sc45Gq2UYdfKr_HaDsxRCGry92UX0i4cJfzM9pk46Rc
৩। https://www.japantimes.co.jp/liveblogs/news/coronavirus-outbreak-updates/
৪। https://www.theguardian.com/world/2020/mar/18/japanese-flu-drug-clearly-effective-in-treating-coronavirus-says-china
৫। https://asia.nikkei.com/Spotlight/Asia-Insight/Japan-s-COVID-vaccine-sprint-becomes-marathon-ahead-of-Olympics

লেখক : গবেষক, হেড অব বিজনেস, আইএলসি টেকনোলজীস, কিউশু, জাপান।

এইচআর/এমকেএইচ