ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

`বিচারহীনতার সংস্কৃতি` বলে আসলেই কি কিছু আছে?

প্রকাশিত: ০৩:৩৩ এএম, ০৯ নভেম্বর ২০১৫

রোববার দুপুর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম ফেসবুকের নিউজ ফিড। বিশেষ করে আলোচিত দুই শিশু হত্যার রায় ঘোষণার পর থেকে। গোটা জাতিই অপেক্ষায় ছিল। এই অপেক্ষা ন্যায় বিচারের। এই অপেক্ষা দায়মুক্তিরও। শিশু হত্যার দায় থেকে মুক্তি পেতে একটা জাতি কতটা অধীর থাকতে পারে- রোববার দেয়া দুইটি রায় যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিল।

আলোচিত আরো কয়েকটি মামলার মতোই শিশু রাজন আর রাকিব হত্যা মামলার রায়ে সন্তুষ্ট গোটা জাতি। সেটাইতো হওয়ার কথা। কারণ হত্যাকাণ্ডের শিকার শিশু দুইটির পরিবার যে ন্যায় বিচার পেয়েছে! অনাকাঙ্খিত দুই মৃত্যুতে রাজন ও রাকিবের স্বজন হয়ে উঠেছিলো গোটা বাংলাদেশ। তাইতো রায় ঘোষণার অনেক আগে থেকেই দুই আদালতের চত্বরে এত মানুষের ভীড়। আসামীদের ঢোকানোর সময় ক্ষোভের এমন বহিঃপ্রকাশ।

বলছিলাম `শিশু হত্যার দায় থেকে মুক্তি`র অপেক্ষায় ছিল গোটা জাতি। ফেসবুকে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখলাম, তার বেশিরভাগে বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা বেড়ে যাওয়া কিংবা আস্থা ফিরে পাওয়ার কথা। এই বিষয়টিই আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে। বলা ভালো ভাবিয়ে তুলেছে কিছুটা। এই যে শ্রদ্ধা বেড়ে যাওয়া, আস্থা ফিরে পাওয়া-এর অর্থ কি? তবে কি বিচার বিভাগের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল না? ছিল না তেমন কোনো আস্থা? তার মানে, বিচার বিভাগের প্রতি এতদিন শ্রদ্ধা কম ছিল, আস্থায় ঘাটতি ছিল- তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। অথচ তেমনটাতো হওয়ার কথা ছিল না! অপরাধীর সাজা হবে- এটাইতো স্বাভাবিক নিয়ম! আর কত অবাক হতে হবে আমাদের!

বিচার বিভাগকে একপেশেভাবে দোষ দিয়ে কতটা লাভ হবে? অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরও কোনো বিচারক অপরাধীকে মাফ করে দিয়েছেন- এমন কোনো নজির কি আছে? বিভিন্ন মামলার রায় পর্যবেক্ষণ করে বরং বলা যায়, সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব, তদন্তে গাফিলতি আর দুর্বল যুক্তি উপস্থাপনের কারণেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যায়। এসবের দায় পুরো বিচার বিভাগকে কেন নিতে হবে? জেনে বুঝে যদি সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি অপরাধীকে পার পেয়ে যেতে সহায়তা করে- সেটি ব্যক্তিগত নৈতিক স্খলন। সেখানে বিচার বিভাগ কিংবা বিচার ব্যবস্থাকে দোষী করা কতটা যৌক্তিক?

এমনিতেই বিচারকস্বল্পতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় বড় একটি সমস্যা। এ কারণেই ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। চাইলেই রাতারাতি হাজার হাজার বিচারক নিয়োগ দিয়ে সরকার এসব মামলার নিষ্পত্তি করতে পারবে না। এগুলোর প্রক্রিয়া আছে। যোগ্য ব্যক্তিকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপার আছে। আছে প্রশিক্ষণের বিষয়টি। তাই দুই একটি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, সরকার চাইলেই ১০ বা ১৪ কার্যদিবসে ৩০ লাখ মামলার নিষ্পত্তি করে দিতে পারে। সেটা যারা ভাবছেন তারা বোকার স্বর্গে আছেন। কেবলমাত্র চাঞ্চল্যকর ও অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোই বিশেষ বিবেচনায় দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৩০ লাখ মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব নয় কোনোভাবেই। বরং অপরাধীকে দিনের পর দিন অসুস্থ দেখিয়ে, আদালতে অনুপস্থিত রেখে আর কারসাজি করে সাক্ষীদের গড়হাজির দেখিয়ে যারা তারিখের পর তারিখ পেছায়, তাদের নৈতিকতার উন্মেষ ঘটানো প্রয়োজন। শুধু টাকার জন্য মক্কেলের স্বার্থ রক্ষা না করে বিচার ব্যবস্থাকে নৈতিকভাবে সহায়তা দিলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে না অনেক মামলা।

তারপরও মাত্র ১০ ও ১৪ কার্যদিবসে এই হত্যা মামলা দুইটির রায় ঘোষণায় আমরা আশার আলো দেখতেই পারি। অ্যাটর্নি জেনারেলও হয়তো এ কারণেই রায় দুইটিকে মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। অবশ্যই তার অন্যতম কারণ, শিশু নির্যাতনকারী আর হত্যাকারীদের জন্য এটি বড় বার্তা। এ ধরনের অপরাধ করে যে পার পাওয়া যাবে না- সেটা অন্তত প্রতিষ্ঠিত হলো। এমনকি অপরাধ করে বিদেশে পালিয়ে গেলেও যে রেহাই মেলে না- সেটা আর কেউ না হোক- সৌদিপ্রবাসী কামরুল ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে। তার বোঝার বিষয়টি পরবর্তীতে অন্য কোনো শিশু নির্যাতনকারীকে নিশ্চিতভাবেই ভাবাবে। আর এটাতো সত্য যে অতীতে আরো অপরাধীকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। কার্যকর হয়েছে অনেকের রায়। যারা এখনো পালিয়ে আছে- আমাদের বিশ্বাস একদিন তারাও তাদের অপকর্মের সাজা ভোগ করবে।

রাজন এবং রাকিব হত্যা মামলার রায় আরেকটা বিষয় আমাদের স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সমাজে বেশ কিছু শৌখিন বুদ্ধিজীবী আছেন। এদের বেশিরভাগই চাঞ্চল্যকর কিছু না হলে পত্রিকার শুধু শিরোনামটুকুই পড়েন। কোনো ঘটনা ঘটলে তাদের মনে একটা ভাব আসে। উথলে ওঠে আবেগের ঢেউ। প্রথমেই তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেটি হলো, ভয়-শঙ্কা। `যদি আমারও এমন কিছু হয়?` এরপরই আসে প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপ। শুরু হয় ভিক্টিমাইজ করা। অর্থাৎ ওই ঘটনার জন্য কাউকে না কাউকে দোষী করা। সেক্ষেত্রে `দোষী নন্দ ঘোষ` হয় সরকার অথবা সরকারের কোনো সংস্থা। শুরু হয়ে যায় পত্রিকা কিংবা অনলাইনে লেখালেখি। আবেগপূর্ণ শিরোনামে আমরা ছাপাই বিদগ্ধজনদের দগ্ধভরা কথামালা। সেসব পড়ে পাঠকের মনেও তৈরি হয় আবেগের একটা দুনিয়া। সেই দুনিয়ার কতটা বাস্তব আর কতটা ভ্রম তা বোঝার বোধ হয়তো থাকে না অনেক পাঠকেরই। কারণ তাদের মনে ততক্ষণে একটা বিভ্রম তৈরি হয়ে গেছে। যিনি লিখছেন, যিনি পড়ছেন- তাদের আবেগের পুরোটাই যে ভুয়া- তা অনুমান করা যায় সহজেই। কারণ ওই আবেগ বুদবুদ হয়ে যায় দুইদিনেই।

দরকার হয় নতুন আবেগ। বর্তমানের আবেগ হচ্ছে `বিচারহীনতা` আর `অপরাধীদের না ধরা`। অথচ রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার রায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর করা- এর সবই প্রমাণ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখনকার বাংলাদেশ নেই। একটা সময় নিশ্চয়ই ছিল। যখন দেশে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা ছিলো না। যখন ক্যান্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র রক্ষার নামে রাজদণ্ড হাতে নিয়েছিলেন জেনারেলরা।

বিচারহীনতার কথা বলা হয় তখনই, যখন কোনো মুক্তমনা ব্লগার কিংবা কোনো প্রকাশককে হত্যা করা হয়। যারা বিচারহীনতার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি- তারা এইসব হত্যাকাণ্ডগুলো তদন্ত এবং মামলার গতিপ্রকৃতি নিয়ে কতটা ওয়াকিবহাল? যেকোনো হত্যাকাণ্ডই অপরাধ। কিন্তু তাই বলে রাজন-রাকিব হত্যার সঙ্গে ব্লগার কিংবা প্রকাশক হত্যাকাণ্ডকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ ওই শিশু দুইটিকে হত্যার পেছনে সুগভীর কোনো ষড়যন্ত্র ছিলো না। ব্লগার-প্রকাশক হত্যাকাণ্ড নিশ্চিতভাবেই সুচিন্তিত। এইসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে কেবলই যে একটি আদর্শিক সংঘাত আছে- তা বলা যাবে না কোনোভাবেই।

এখানে বরং একটি আদর্শকে আরেকটি আদর্শের পেছনে সশস্ত্রভাবে লেলিয়ে দেয়ার ইঙ্গিত মেলে। যুক্তির বিপরীতে পাল্টা যুক্তি না দিয়ে কেন অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হচ্ছে? কিসের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে এখানে? কাদের জন্য পথ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে? কারা করছে এসব? এতসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া এই রাষ্ট্রের জন্য বড় বেশি প্রয়োজন। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা হাতেনাতে ধরা পড়েছিলো- এটা ঠিক। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই তাদের সাজাও হয়তো হবে। সেটা হওয়াই কাম্য। কিন্তু তাতেই কি সব থেমে যাবে। একজন শিশু নির্যাতনকারীর সাজায় আরেকজন শিশু নির্যাতনকারী ভয় পাবে। কিন্তু আদর্শের নামে, বিশ্বাসের নামে, ধর্মের নামে যাদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে- তারাতো একজন কিংবা দুইজনের সাজায় ভয় পাওয়ার নয়। সেক্ষেত্রে মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করা ভীষণ দরকার। তাতে বিচার কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। তাকে বিচারহীনতার প্রমাণ কিংবা ধরন বলা যায় না কোনোভাবেই।

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীব হায়দারকে। আট আসামীর মধ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।  অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাতজনকে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় এ বছরের ৩০ মার্চ। পাঁচ আসামীর মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। ১২ খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। এই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে। আবার অভিজিৎ হত্যায় গ্রেপ্তার আসামীদেরও এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ৭ আগস্ট খুন হন নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে। ২৮ সেপ্টেম্বর ইতালিয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই সরব গোটা বিশ্ব। এরপর খুন হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি। তাভেলা হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করেছে সরকার। গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে। অন্যদিকে, কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

একমাত্র রাজীব হায়দার হত্যা মামলাটি চলছে প্রায় আড়াই বছর ধরে। বাকিগুলো কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে তাড়াহুড়া করার কোনো সুযোগ আছে কি? নাকি তাড়াহুড়োয় সংস্থাগুলোর ওপর চাপ তৈরি করা যৌক্তিক? এই মামলাগুলোকে যে সরকার গুরুত্ব দিয়েই দেখছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এগুলোর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা এবং দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। তাই সরকার ইচ্ছে করেই দীর্ঘসূত্রতা ঘটাচ্ছে সেটা বলার সময় বোধ হয় এখনো সময় আসেনি। আমার সঙ্গে দ্বিমত জানানোর লোকের অভাব হবে না। তারা হয়তো নির্দিষ্ট কিছু মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করে বিচারহীনতার বিষয়টি প্রমাণের চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেটি করার আগে অন্তত বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা উচিৎ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে যদি সত্যিই কোনো অপরাধী পার পেয়ে যায়- কেন তারা পার পেয়েছে? কার গাফিলতিতে পার পেয়েছে? সেখানে বিচার ব্যবস্থার দায় কতখানি আর বিচার ব্যবস্থায় জড়িতে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের হিসেব কতখানি- সেটা পর্যালোচনা করা দরকার।

কাজেই দ্রুততম সময়ে রাজন ও রাকিব হত্যার বিচার আমাদের যেমন আনন্দিত করছে, প্রত্যাশার ক্ষেত্র তৈরি করছে- একইসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের তাগিদও দিচ্ছে। `বিচারহীনতার সংস্কৃতি` বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলার কোনো মানে হয় না। বরং বিচার প্রক্রিয়াকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দেয়া উচিত। তাতে অন্তত সঠিক বিচার নিশ্চিত হওয়ার সুযোগটাই বেশি থাকে। সঠিক তদন্ত হলে বেরিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশবিরোধী চক্রের হোতাদের নাম। তাতে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ। রক্ষা পাবে বাঙালি। তাই বিচারহীনতার স্লোগান বাদ দিয়ে আসুন ষড়যন্ত্রের জাল ছেঁড়ার প্রত্যাশা করি। সরকার এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে সেই সময়টুকু অন্তত দেই আমরা।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]

এইচঅার/এমএস

আরও পড়ুন