ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন রাজনীতিতে নিবেদিত একজন মানুষ

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ১০:২১ এএম, ০৯ অক্টোবর ২০২০

আজ ৯ অক্টোবর মোহাম্মদ ফরহাদের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে এতগুলো বছর কেটে গেল। আজকের প্রজন্ম মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্ক খুব বেশি কিছু জানে বলে মনে হয় না। জীবিতকালে যিনি দেশের রাজনীতিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, মৃত্যুর পর এই তিন দশকের একটু বেশি সময়ের মধ্যেই তিনি রাজনীতিকদের কাছেও যেন এক অপরিচিত নাম। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। কমিউনিস্ট হয়েও একজন জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একেবারে স্কুলজীবন থেকে শুরু করও আমৃত্যু তিনি ছিলেন আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ। রাজনীতি ছিল তার সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞান।

গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক’ বলে পরিচিত মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজ প্রগতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও পালন করেছেন অগ্রসৈনিকের ভূমিকা।

মোহাম্মদ ফরহাদের একসময়ের সহকর্মী ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ড. নূহ উল আলম লেনিন লিখেছেন, ‘বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম রূপকার মোহাম্মদ ফরহাদ হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেই কেবল তিনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন। কমিউনিস্ট পার্টিও বৈধ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সংগঠক এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি দলটির সাধারণ সম্পাদক পদে বৃত হন এবং আমৃত্যু তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর মস্কোতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মোহাম্মদ ফরহাদের জীবনাবসান ঘটে।’

মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন এক সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনি ছিলেন দুই প্রজন্মের-চল্লিশ দশকের পথিকৃত কমিউনিস্ট বিপ্লবী মণি সিংহ, বারীন দত্ত, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি ও জ্ঞান চক্রবর্তীদের প্রজন্ম এবং সত্তর ও আশির দশকের তরুণ কমিউনিস্ট প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধ স্বরূপ। দুই প্রজন্মের মধ্যেই তিনি ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত। তবে এ কথা মানতে হবে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হলেও ধ্যানে, জ্ঞানে, জীবনযাত্রায় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের চিরায়ত ঘরানার কমিউনিস্টদের সার্থক নেতা ও বিপ্লবী। এ দেশে একটি শোষণ-বঞ্চনা-ভেদ বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। স্বপ্ন রূপায়নের জন্য প্রয়োজন বিপ্লবের। তার ছিল আকণ্ঠ বিপ্লব পিপাসা।

একজন নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে খুব অল্প সময় পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্বল্পায়ু তৃতীয় জাতীয় সংসদে (১৯৮৬-৮৭) তার ব্যতিক্রমী ভূমিকা, যুক্তিপূর্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত বাগ্মীতা নিয়ে একজন প্রতিশ্রুতিশীল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। ‘জাতীয় রাজনীতি, ছাত্র, শ্রমিক, নারী আন্দোলন, যুব, ক্ষেতমজুর, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা কর্মকাণ্ড এবং সিভিল সোসাইটির তৎপরতার পেছনেও ছিল মোহাম্মদ ফরহাদের অবদান। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আন্দোলনে এবং সংগঠন গড়ে তোলার পেছনেও তিনি অনুঘটকের নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তার অকালপ্রয়াণ সত্যি সত্যি বাংলাদেশের বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্ট করে।’

তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করেছেন প্রচুর। আমাদের দেশের প্রথম সারির রাজনীতিবিদরা সাধারণত লেখালেখি করেন না। মোহাম্মদ ফরহাদ এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। পার্টির মুখপত্র, তাত্ত্বিক পত্রিকা ও কোনো কোনো সময় জাতীয় দৈনিকেও তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। মোহাম্মদ ফরহাদ ষাটের দশকে কিছু সময়ের জন্য দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে তার আকস্মিক মৃত্যুতে দেশের রাজনীতি সচেতন মহলে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তার জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল যে তিনি মানুষের কাছে কত প্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

দুই.

মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর দেশের প্রধান সারির কবিরা কবিতা লিখে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
শামসুর রাহমান তার কবিতায় লিখেছিলেন :
অকস্মাৎ এ কেমন নিস্তব্ধতা এলো ব্যেপে দেশে? এ কেমন সূর্যাস্তের ছটাবিলাপের মতো আকাশে ছড়িয়ে পড়ে? বেদনার্ত পাখি নীড়ে ফেরা ভুলে যায়, ফুল উন্মীলনে পায় না উৎসাহ, নদীতে জোয়ারভাটা থেমে যায়; মনে হয়, পঞ্চাশ হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কী ভীষণ বাষ্পাকুল। না তোমাকে মানায় না এ রকম কাফনের শাদামোড়কে সাজানো শুয়ে থাকামাটির গভীরে, না তোমাকে মানায় না; এ গহন স্তব্ধতায় মিশে থাকা সাজে না তোমাকে।

সৈয়দ শামসুল হক লিখেন অমর পংক্তিমালা :
তাহলে বিদায়, বন্ধু, তাহলে বিদায়; এভাবে, এ অবেলায়, সূর্যের অস্তের আগে আমাদের কণ্ঠে তুলে নিতে হচ্ছে সূর্যাস্তের গান, সবচেয়ে প্রয়োজন যখন আপনাকে, আমাদের বলতে হচ্ছে ‘বিদায়’। তাহলে বিদায়, বন্ধু, একই জলহাওয়ায় বর্ধিত, আঞ্চলিক একই ভাষা দুজনেরই বলে আমি ঈষৎ গর্বিত, ভাষা আজ ভাষাহীন, বুদ্ধি আজ সাময়িকভাবে স্তম্ভিত; হ্যাঁ, সাময়িক অবশ্যই বটে; আপনার জীবন ছিল ক্রমশ বৃদ্ধির- অকস্মাৎ, হে বন্ধু বিদায়।

নির্মলেন্দু গুণের বিশাল কবিতার কয়েক লাইন :
যাক বাবা, বাঁচা গেল, আল্লাহর কাছে হাজার শোকরমণি সিংহের চেলাডা মরেছে। ব্যাটা গোকূলে কৃষ্ণের মতো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল এই ধর্মপ্রাণ বঙ্গভূমিতে আফগান স্টাইল বিপ্লব করবে বলে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি সময় বুঝে তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন। ব্যাটা ছিল ঝানু পলিটিশিয়ান, মানতেই হবে। উইকেটের চারপাশে ব্যাট চালাচ্ছিল, রিচার্ডসের মতো, ব্যাট তো নয়, যেন ঈশা খাঁর ক্ষীপ্র তরবারি- এখন আশা করি বিপ্লবের রান-রেটটা একটু ফল করবে। কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারব।

সত্যদর্শী কবির কথা মিথ্যা হয়নি। মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নিঃস্ব করেছে। তার চলে যাওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টি আজ উত্থানরহিত। গণতান্ত্রিক শক্তিও পথহারা। ধর্মান্ধতা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রতিক্রিয়ার শক্তিরা উল্লসিত। এই অবস্থায় মোহাম্মদ ফরহাদের কথা বেশি করে মনে পড়ে। তিনি যদি আরও কিছু বেশি সময় পেতেন তাহলে হয়তো দেশের রাজনীতি এতটা আদর্শহীনতার পথে ধাবিত হতো না।

ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ করে দেখাই রীতি। কোনো একক ব্যক্তি নয়, সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ মানুষের শক্তিই ইতিহাসের স্রষ্টা। কিন্তু সত্যিই কি ইতিহাস নির্মাণে ব্যক্তির কোনো ভূমিকা নেই? বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি কি ইতিহাসের গতিধারার অদলবদল ঘটায় না? ঐক্যবদ্ধ মানুষের সম্মিলন ঘটাতেও কি ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা প্রভাব বিস্তার করে না? যে যাই বলুন, যেভাবেই বলুন, মোহাম্মদ ফরহাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক নির্ভরযোগ্য ও নিয়ামক শক্তি ছিল।

তিন.

শেষ করব প্রয়াত কমিউনিস্ট বিপ্লবী জসিমউদ্দিন মন্ডলের একটি লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে। সাত বছর আগে মোহাম্মদ ফরহাদকে স্মরণ করে একটি লেখায় জসিম মন্ডল লিখেছেন : জিয়াউর রহমানের সরকার প্রচার করলো ময়নমনসিংহ শম্ভুগঞ্জ জুট মিল ভেঙে যাচ্ছে নদীভাঙনে। এটা জাতীয় সম্পদ, এটাকে রক্ষা করা জাতীয় দায়িত্ব। তাই সরকারের তরফ থেকে বলা হলো, দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে আসেন মিলটাকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাই।

সব দলের কাছে সরকারিভাবে চিঠি দিল- শম্ভুগঞ্জে মিল রক্ষার্থে পার্টিতে আলোচনা হচ্ছিল, কিন্তু সিদ্ধান্ত হচ্ছিল না। কেউ বলে যাওয়া উচিত, বালু কেটে মাটি কেটে ভাঙন ঠেকাতে হবে। জিয়াউর রহমানের ডাকে যাওয়া ঠিক না বেঠিক- এটা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল পার্টিতে। কিন্তু ফরহাদ ভাই আবার পার্টিতে মতপ্রকাশের অধিকার দিতেন। বলতেন, মেলা মত থাকতে পারে- মত যতই থাক না কেন একসাথে কাজ করছি কিনা সেটাই বড় কথা। তিনি জোর করে নিজের মত চাপিয়ে দিতেন না।

আলোচনার সময় কেউ কাউকে বাধা দিলে ফরহাদ ভাই বলতেন, কমরেড ওনার মতটি শুনুন, বলতে দিন। তারপর গ্রহণ করবেন, না করবেন না- সেটা হাউজ ঠিক করবে। এইভাবে তিনি সবাইকে একভাবে চালাতে চেষ্টা করতেন। এভাবে সকলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে খাল কাটার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলো। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু তার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়।

এরপর জসিম মন্ডল লিখছেন : ফরহাদ ভাইকে আমি দেখেছি সারাক্ষণ পার্টি নিয়ে ভাবতে। পার্টিকে কীভাবে বড় করা যায়, কীভাবে পার্টির জনসমর্থন বাড়ানো যায়, তিনি সবসময় সেসব নিয়ে ভাবতেন। আমরা মর্মাহত, ব্যথিত, তার মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ কমরেড আর আমাদের মাঝে নাই। -- মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফরহাদ ভাইয়ের মতো, মণি সিংহের মতো করে কাজ মনে হয় হচ্ছে না। এখন তো টিনের ঘর নাই, মস্তবড় দালান, কত শান-শওকত। তবুও কতটা আগাচ্ছি সামনে তা নিয়ে যখন ভাবি তখন এসব কমরেডের কথা মনে পড়ে। -

কমরেড ফরহাদের মতো আত্মত্যাগী নেতাদের কথা আমাদের যত বেশি মনে পড়বে ততই দেশের রাজনীতির জন্য মঙ্গল। কমরেড ফরহাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেকক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/এমএস