ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ছেলে উজ্জ্বল মেয়ে কেন বোঝা?

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০২০

ফারিয়া ইয়াসমিন

করোনা মহামারির সাথে সাথে বিভিন্ন সমস্যা প্রকট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্ভোগ বাড়ছে মানুষের। পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে সকলে। এর মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কিছু সংকট। যার মধ্যে পুরোনো কিছু সামাজিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। করোনাকালে বেড়েছে অন্যতম সামাজিক সমস্যা বাল্যবিবাহ। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। যার মধ্যে কিশোরীরা বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে। দেশে আগের তুলনায় এই সময়ে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।

মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহুদিন ধরে বন্ধ থাকার কারণে সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত পিতা-মাতারা মেয়েদের বাল্য বিবাহের দিকে আগ্রহী হচ্ছে বেশি।আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব এই সামাজিক সমস্যার প্রভাব কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, গত জুন মাসে আশঙ্কাজনক হারে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, বাল্য বিবাহের তথ্য নিয়মিত তাদের কাছে আসছে আর তা আগের চেয়ে অনেক বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামের মেয়েরা বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে চুপিসারে দেওয়া হচ্ছে এসব বাল্যবিবাহ। মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ও অনেকে বাল্যবিবাহ দিচ্ছে কিন্তু তারা ভেবে দেখে না মেয়েরা স্বামীর ঘরেও নির্যাতিত হচ্ছে। একটা পরিবারে যখন ছেলে সন্তানকে উজ্জ্বল ভবিষ্যত হিসেবে দেখা হয় তখন কেন একটা মেয়েকে বোঝাস্বরূপ দেখা হবে? এই প্রশ্নটা আজকের নয়। বহুকাল ধরেই এই প্রশ্ন আমাদের সমাজে বিরাজমান। তবে মনে রাখা দরকার বাল্যবিবাহ একজন কিশোরীর জন্য কখনো সুফল বয়ে আনে না। করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক , সামাজিক সংকটে কন্যা শিশু, কিশোরীদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার কারণে বাল্যবিবাহ ঝুঁকি বেড়ে গেছে।

আমাদের দেশ উন্নয়নশীল হয়েছে। আগের চেয়ে উন্নত সমাজে বসবাস করি আমরা। কিন্তু কিছু প্রচলিত সামাজিক সমস্যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মাঝে থেকে গেছে যেগুলো পরিস্থিতিতে ভিত্তিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তেমনি করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ছে বাল্যবিবাহ। আমরা নারী শিক্ষার পথে পা দিয়েছি কিন্তু নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারিনি। এখনো অনেক পরিবারের কাছে মেয়েরা বোঝাস্বরূপ। কেন এই বৈষম্য? নারীদের ক্ষমতায়ন কি তাদের চোখে পড়ে না? বাল্যবিবাহের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ বিশ্বে ৪র্থ।

ইউনিসেফ তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ ভাগ মেয়ে ১৮ বছরে পদার্পণ করার আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। ২০১০ সালের পরিসংখ্যান ছিল আরও ভয়াবহ। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এর মতে ২০১০ সালে ১৮ বছর হয়নি এমন কিশোরীর শতকরা ৬৫ ভাগ কে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে এই সংখ্যা কমিয়ে ৫৯% এসে দাঁড়ায়। তবে মহামারিতে পরিস্থিতি আবারো অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। শুধুমাত্র জুন মাসেই ৪৬২ জন কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয় যার মধ্যে ব্যক্তিগত, সরকারি উদ্যোগের ২০৬ টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা গেছে। বাল্যবিবাহের কারণ কি? এই মহামারিতে কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই হার? কারণগুলো অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। ব্রাক এর একটি গবেষণায় দেখা যায় শতকরা ৮৫ ভাগ বাল্যবিবাহ হচ্ছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কারণে। শতকরা ৭১ ভাগ বাল্যবিবাহের শিকার হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।

পরিবারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিয়ের অনুপযুক্ত মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে । করোনার কারণে নারী ও শিশুদের জীবনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে ।বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মেয়েদের ওপর। অভিভাবকদের কর্মহীনতা, সন্তানের স্কুল খোলার নিশ্চয়তা না থাকা এবং নিরাপত্তা বোধ থেকে দেশে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। গ্রামের মেয়েরা বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে এবং ছেলেদেরকে কর্মে নিযুক্ত করা হচ্ছে। বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা আর পড়ালেখার সুযোগ পাবে না তেমনি কর্মে নিযুক্ত হয়ে যাওয়া অনেক ছেলেরাও ফিরতে পারবে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যম "টেলিগ্রাফ" এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোন মহামারির পর প্রায় এক কোটি শিশু স্কুলে যেতে পারবে না । প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে মহামারির কারণে বর্তমানে প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী স্কুলের বাইরে। সংক্রমণ শেষে স্কুল খুলে দিলেও গরীব শিশুরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বিশেষ করে মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়বে। বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ হিসেবে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ থাকা বিবেচনা করা যায় তেমনি বাল্যবিবাহের প্রভাব পড়বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ গুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ অন্যতম।

গতবছরে প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ ও মাধ্যমিক স্তরের ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতে মেয়েদের ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার আরো বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় মেয়েদের ক্ষেত্রে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না সেখানে করোনা পরবর্তী নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমবে আশঙ্কাজনকভাবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪১ ভাগ মেয়ে শিক্ষার্থী ও ৩৩ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে । করোনাকালে আরো ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আশঙ্কা করার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হচ্ছে। যদিও শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে তবুও অনেক শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে। পরিবারের আয় কমে যাওয়া শিক্ষার্থীদের শ্রমের হার বেড়েছে। যেহেতু করোনা পরবর্তীতেও আর্থিক সংকট বিরাজ করবে সেহেতু অনেক পরিবার চাইবে সন্তানরা তাদেরকে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে সাহায্য করুক।

তার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে আসা কঠিন হবে। ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির সমস্যাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। করে বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরীদের ঝরেপড়া রোধে উপযুক্ত পরিকল্পনা নিতে হবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিশেষ সামাজিক সেবার আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে স্কুল ও বই খাতার পেছনে যেন দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কোনো অর্থ খরচ করতে না হয় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য সরকার বিশেষ কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। এক্ষেত্রে নারী শিক্ষায় যেন তাদের মনে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয় না থাকে তাই নারীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করার জন্য স্থানীয় জনসমাজ ও সরকারের সম্পৃক্ততা অতীব জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ