জেলহত্যা দিবসের অঙ্গীকার
জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন জেলহত্যা দিবস আজ। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত সহচর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছেন তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন এই জাতীয় চারনেতা।
পৃথিবীর ইতিহাসে জেলখানার মতো নিরাপদ জায়গায় এ রকম হত্যার নজির নেই। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ধারাবাহিকতায় মূলত জাতীয় চার নেতাকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হত্যা করা হয়। প্রথমে ঘাতক খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় ভেড়ানোর চেষ্টা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধু এবং দেশের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যাতে এরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে সে জন্য চিরতরে তাদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ঘাতক চক্র। সে অনুযায়ী রাতের আঁধারে তাদের জেলাখানার ভেতর হত্যা করা হয় নিষ্ঠুর পৈশাচিকতায়। এর মধ্য দিয়ে মূলত সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পেছনে চলা শুরু হয়। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাসা বাঁধে।
স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হয়। দুই দফায় সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখে। জেলহত্যার বিচারের পথও রুদ্ধ করে রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন করে বন্ধ রাখা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। কিন্তু ইতিহাসের চাকা সবসময় একদিকে ঘুরে না। এক সময় শেষ হয় ঘাতকের দিন। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ জনরায় নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচারের পথও সুগম হয়।
হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারকাজ শুরু করে। পরবর্তী সময় বিচারকাজ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। ২৯ বছর পর ২০০৪-এর ২০ অক্টোবর অভিযুক্তদের মধ্যে পলাতক ৩ জনের ফাঁসি, জেলে অবস্থানরত ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জামিনে মুক্তদের নির্দোষ ঘোষণা করে বিচারিক আদালত দায়সারা একটি রায় দেয়। রায়ে এত বড় একটি ঘটনায় ষড়যন্ত্রীদের শাস্তির আওতায় না আসাও জাতিকে বিস্মিত করে। পরে ডেথ রেফারেন্স ও রায়ের বিরুদ্ধে আসামি পক্ষের করা আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে বেকসুর খালাস এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্তদের মধ্যে চারজনকে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দেন। এ রায় জাতিকে আরো স্তম্ভিত ও মর্মাহত করে। আত্মস্বীকৃত মূল আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে এটা কারো কাছেই প্রত্যাশিত ছিল না। বিস্ময়করভাবে তখন রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করেনি।
এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রত্যাশিত আপিল দায়ের করা হয়। আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির বেঞ্চ গত বছরের ৩০ এপ্রিল রায় দেন। হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। জেলহত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আসামিই বর্তমানে পলাতক রয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় চারজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে। সম্প্রতি একজনের মারা যাওয়ার খবর জানা গেছে। এখন প্রশাসনের দায় পলাতক দণ্ডিত আসামিদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করা। যাতে এর মধ্য দিয়ে জাতি অভিশাপ মুক্ত হতে পারে।
এ বছর জেলহত্যা দিবস পালন হচ্ছে এমন এক সময় যখন একের পর এক ব্লগার হত্যা করা হচ্ছে। লেখকদের পর এখন আঘাত এসেছে প্রকাশকদের ওপর। ধর্মান্ধ গোষ্ঠির এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে হলে সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে। এইদিনে বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারই হোক আজকের শপথ।
এইচআর/এমএস