ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শমসের মবিনের রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া এবং বিএনপি

প্রকাশিত: ০২:২১ এএম, ০২ নভেম্বর ২০১৫

অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিএনপি থেকে পদত্যাগ এবং রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক কূটনীতিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। তার এই ঘোষণায় বিএনপিতে হতাশা, আওয়ামী লীগে উল্লাস এবং মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনা চলছে। বিভিন্ন জন এ নিয়ে নানা কথা বলছেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন। রাজনীতিতে এ ক’দিন মবিন চৌধুরী ইস্যুই প্রধান হয়ে উঠেছে। যদিও এরিমধ্যে ব্লগার হত্যা, বিদেশি হত্যা, তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে, এখনও শেষ হয়ে যায় নি, তথাপিও মবিন চৌধুরীর রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণার বিষয়টি আলোচনায় নানা কারণেই প্রাধান্য পাচ্ছে।

শমসের মবিন চৌধুরী কূটনীতির পেশা শেষে বিএনপিতে যোগ দেন। দলের চেয়ারপার্সনের তিনি বেশ ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই পরিচিত। বিশেষত কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কারণে  দলে বেশ উঁচুতে ছিলেন তিনি। তবে বিএনপির গেল এক বছরের সন্ত্রাস নির্ভর আন্দোলনের অবস্থান মবিন চৌধুরীসহ অনেকে কতোটা সমর্থন করতেন তা জানা না গেলেও এই রাজনীতির কারণে তাকে বেশ ক’বার গ্রেপ্তার বরণ করতে হয়েছে, সব শেষ তিনি গত জানুয়ারিতে জেলেও গেলেন। বেশ ক’মাস জেলে কাটিয়ে মুক্তি পেলেও তার বিরুদ্ধে বেশ ক’টি মামলা আছে। তিনি যদিও তার রাজনীতি ছাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের অবনতির কথা জানিয়েছেন, অন্য কোনো কারণ বা দলের কোনো অবস্থানের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণের কোনো ইঙ্গিতও তিনি দেন নি, তথাপিও রাজনীতি বিশ্লেষক মহল যে বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন তা হচ্ছে, সিলেটে শমসের মবিন চৌধুরী বরাবরই ইলিয়াস আলী এবং তার গ্রুপের লোকজনের চরম বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন এবং এখনও আছেন- তা হয়তো তাকে হতাশ করতে পারে।

এছাড়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তার টেলিফোন কথোপকথন থেকে যা বোঝা গেছে তাতে মনে হয়েছে যে, তাদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট রয়েছে। তা ছাড়া জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ না করা, কারো সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা না করা ইত্যাদি কারণে তার ভূমিকা নিয়ে দলের শীর্ষ মহলে এক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠেছে। দলের নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখে তো থাকতে হচ্ছেই। এসব কারণে হয়তো সত্যি সত্যিই রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারেন এই বর্ষীয়ান কূটনীতিক। তার বয়স তো কম হয় নি। এতোসব চাপ নেওয়ার বিষয়টিকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা ছাড়া বিএনপির রাজনীতির কোথায় মাথা, কোথায় পা তা এখন খুঁজে পাওয়া তো বেশ কষ্টকর। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার কৌশল বিএনপির একেবারেই শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতার সিদ্ধান্তের বিষয় ছিল- যার সঙ্গে অন্য কোনো স্তরের নেতা কর্মীদের মত ছিল না।

নির্বাচন প্রতিহত করার কৌশল নিয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ের যে সব ঘটনা সংঘটিত করা হয়েছিল তার সঙ্গে বিএনপির এতো বছরের নীতি ও কৌশলের কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন  হয়ে পড়েছে। জামায়াতের ক্যাডার এবং সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি একাকার হয়ে ২০১৩ সাল এবং ২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসের যে পেট্রল বোমা ও মানুষ পুড়িয়ে মারার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছিল তার ফলে বিএনপির রাজনৈতিক ভাবমূর্তি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। দেশ-বিদেশে বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। বিএনপির মতো একটি দল নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করতে গিয়ে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে টিকে থাকা কতোটা কষ্টকর হবে তা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আগ থেকে বুঝতে চায় নি। নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ফলে সকল স্তরের নেতা কর্মীরা নানা মামলা মোকদ্দমায় যেমনি জড়িয়ে পড়েছে, ক্ষমতায় যাওয়ার যে স্বপ্ন তারা ২০১৩ সালে দেখেছিল তা গুঁড়িয়ে গেল, ভবিষ্যতে কখন আবার বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরে আসবে-তা নিয়ে বেশ সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

বিএনপির রাজনীতি নিয়ে সত্যি সত্যিই বড় ধরনের একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এটি তৈরি করেছেন দলের চেয়ারপার্সন এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমান লন্ডনে দীর্ঘদিন থেকে অবস্থান করছেন। সেখানে থেকে তিনি দলকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন, অনেক সিদ্ধান্ত তিনিই বিভিন্ন জনের মাধ্যমে দিয়ে আসছেন। সে সব সিদ্ধান্তে দল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলে আনুগত্য প্রকাশের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে। কেউবা চেয়ারপার্সন, কেউবা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে আনুগত্য দেখাচ্ছেন। এ সব নিয়ে দলে সমন্বয়হীনতা বেড়েই চলেছে। দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চেয়ারপার্সনের খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে না, বৈঠকেরও ডাক পড়ছে না। সবাই অনেকটা অলস সময় বা যার যার কাজ নিয়ে পড়ে থাকা, অথবা মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে।

কিন্তু দলে মতামত দেওয়া ও পাওয়ার ক্ষেত্রে কারো কোনো অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই বিএনপির রাজনীতি নিয়ে এখন হতাশা ও কিংকর্তব্য বিমূঢ় অবস্থায় আছেন। দলে এক অর্থে আছেন, আবার দলের কোনো সভা ও কর্মসূচি নেই-এমন স্থবির অবস্থায় বিএনপি নিকট অতীতে কখনো পড়ে নি। ১৯৮১-৮৩ সালে দলটি একবার মহাসংকটে পড়েছিল। কিন্তু এরপর তা কাটিয়েও গেছে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। কিন্তু ২০১৩ সালে ক্ষমতায় যাওয়া বা পাওয়ার যে সম্ভাবনা দলটির জন্য তৈরি হচ্ছিল তা দলের শীর্ষ পর্যায়ের ভুল রাজনীতির কারণে একেবারেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফলে দল মহাবিপর্যয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় যাওয়া দূরে থাক, বিরোধী দলের আসনে বা প্রটোকলেও দল নেই।

আগামী নির্বাচনের বাকি আছে তিন বছরের কিছু বেশি। এর মধ্যে দেশে নানা হত্যা, খুন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির স্বচ্ছতার যে সব অভিযোগ উঠছে তাতে বিএনপি আরও সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এমন সময়ে দলের চেয়ারপার্সন লন্ডনে অবস্থান করছেন। অনেকের কাছেই বিষয়টি মোটেও স্পষ্ট নয়- আসলে বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দলকে নিয়ে কী করতে চাচ্ছেন? দলের অভ্যন্তরে ছন্ন ছাড়া অবস্থা, বাইরে মিডিয়ায় অনেক কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু নেই কোনো কর্মসূচি, নেই কোনো সাংগঠনিক চিন্তা-ভাবনা। কে কোথায় কী করছে, তার কোনো সদুত্তর কারো জানা নেই। সব কিছুই লেজে গোবরে অবস্থা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে দলের ভেতরে আলোচনা পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল, সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি ছিল, জামায়াতের সঙ্গ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি বিএনপির অভ্যন্তরে একটি স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে আছে। এসব বিষয় দিন দিন জটিল হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপির এই অবস্থা নিয়ে যে সব মন্তব্য করছেন-তাতে খুব বেশি লাভ আওয়ামী লীগের হয় কি না সন্দেহ আছে। বরং জনমনে সন্দেহ তৈরি হতে সুযোগ করে দেয় যে, সরকার সম্ভবত এসব ভাগাভাগি, ভাঙ্গাভাঙ্গির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কেন এসব মন্তব্য করতে যায় তা জানি না। সরকারের নীরবতা প্রকাশই জনগণকে বিএনপিকে বুঝতে, উপলদ্ধি করতে অনেক বেশি সহায়তা করতো বলে মনে হয়। বিএনপির প্রতি সহানুভূতি তৈরি করার মতো কথাবার্তা আওয়ামী লীগ নেতারা ক্রমাগত বলেই যাচ্ছেন। এটি বিএনপির জন্যে লাভ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের জন্যে ক্ষতি হচ্ছে- বিষয়টি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কতোটা বুঝতে পারছেন- জানি না।

বিএনপি আদর্শগতভাবে ডান ধারার মানুষের ভরসার আশ্রয়স্থল। তবে বিএনপির ভেতরের রাজনীতির শূন্যতা যত বেশি উন্মোচিত হবে তত বেশি দলের সমর্থক পর্যায়ে ভাঙ্গন ধরার সুযোগ তৈরি হতে পারে। সেটি রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই কেবল ঘটবে, কৃত্রিম উপায়ে কোনোভাবেই তা হবে না। সে জন্য আওয়ামী লীগকে আরো বুঝে-শুনে বিএনপিকে নিয়ে মন্তব্য করা উচিত। বিএনপি এখন চরম সংকট অতিক্রম করছে।  আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতিকে কতোটা যৌক্তিক এবং নিয়মসিদ্ধভাবে কাজে লাগাবে তার ওপর নিকট ভবিষ্যৎ রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগেও তো তেমন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড খুব একটা নেই। নেতাকর্মীগণ কতোটা এই মুহূর্তের করণীয় সম্পর্কে সচেতন-তা বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ এখন রাজনীতিতে যে অধ্যায়টি অতিক্রম করছে তার চরিত্র নিরূপণ করা ও করণীয় নির্ধারণ করা খুবই জরুরি রাজনৈতিক কাজ। সেই কাজ রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে।

patoary

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন