রাজনীতি এখন শমসেরকেন্দ্রিক?
শমসের মবিন চৌধুরীকে দেখলেই মনে হবে নিপাট ভদ্রলোক। উপমহাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে এমন সৌম্য চেহারা, শালীন কথাবার্তার রাজনীতিবিদ খুব যে বেশি আছে তা কিন্তু নয়। এখানে রাজনীতিবিদদের ভিন্ন একটি চরিত্র দিয়ে থাকি আমরা। তার খানিকটা বাস্তব, খানিকটা রঙচঙ মেশানো। রূপালী পর্দা থেকে পাওয়া ধারণা থেকে আমাদের কল্পনা একজন গড ফাদারের যে রূপ অঙ্কন করে- অনেকটা সেরকম। শমসের চৌধুরীর সঙ্গের এই চেহারা মেলানো যায় না কোনোভাবেই। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুতর আহত হন শমসের মবিন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু `৭২-এর জানুযারিতে দেশে ফিরে জানতে পারেন এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার কথা। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেন তৎকালীন পূর্ব-জার্মানির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। শমসের সাহেবকে তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখানে পাঠান। সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে তাকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু `৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরপরই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই শমসের মবিন হয়ে ওঠেন জেনারেল জিয়ার অত্যন্ত প্রিয় এবং অাস্থাভাজন। অভিযোগ আছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদে প্রতিষ্ঠা করার মিশন নাকি দেয়া হয়েছিলো তাকেই। এ কারণেই তাকেও ন্যস্ত করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেই দায়িত্ব যে মবিন সাহেব নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছিলেন- তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। এই নিষ্ঠার কারণেই তার হাতে নাকি নিগৃহীত হতে হয়েছিলো তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাকে। ঘটনার পরম্পরায় চাকরিশেষে জিয়া`র প্রতিষ্ঠিত বিএনপি`র রাজনীতিতে যোগ দেন শমসের মবিন। এক পর্যায়ে ভাইস চেয়ারম্যান। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস! সেই বিএনপি থেকেই বিদায় নিতে হলো তাকে।
কেন পদত্যাগ করলেন শমসের মবিন চৌধুরী? নাকি পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি? নাকি পদত্যাগ করানো হলো তাকে দিয়ে? সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া উচিৎ না কারোরই। বড়জোর নিজের ধারণা কিংবা বিশ্বাস তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু সেটাই যে ধ্রুব- তা চিন্তা করাটা কেবলই বোকামি হবে। সে যাই হোক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মবিন সাহেব এখন বিশেষ একটা ক্ষেত্র তৈরি করেতে পেরেছেন। সেটা নিজে থেকে অথবা অন্য কোনো পক্ষ তা করে দিয়েছে। সাদা চোখে এই পদত্যাগের প্রতিক্রিয়া যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কোনো ব্যতিক্রম নেই। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে আসছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য, ভিন্ন ব্যাখ্যা আর পাল্টাপাল্টি দাবি। কিন্তু লেবুটা বেশি কচলে তিতাটা যে বের করে ফেলা হচ্ছে- সেদিকে কারো খেয়াল আছে কিনা সন্দেহে।
`সন্দেহ` বলছি তার কারণও আছে। কারণ `রাজ` নীতি নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারা কিছু না বুঝেই কথার রাজনীতি করছেন সেটা হতে পারে না। শমসের মবিন রাজনীতি ছাড়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই অভিনন্দন জানালো আওয়ামী লীগ। এরপর বিএনপি`র পক্ষ থেকে বলা হলো, এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। তাতে কিন্তু রেহাই পেলো না `লেবু`। কচলাকচলি শুরু হয়ে গেলোই। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গল্প। এরমধ্যে সবচেয়ে জোরালো গল্প দুইটি। গল্প না বলে দাবি বলাই ভালো। শমসের মবিন নাকি তার উপর বর্তানো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি সুষ্ঠুভাবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের বিএনপি`র পক্ষে সেভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। বহির্বিশ্বে বেকায়দায় ফেলতে পারেননি আওয়ামী লীগ সরকারকে। তাতেই নাকি ক্ষেপেছেন লন্ডনে পলাতক তারেক রহমান। একজন পলাতক আসামীর পরিকল্পনামাফিক ফল এনে দিতে না পারাতেই নাকি দল ছাড়তে হয়েছে তাকে। অন্যদিকে, যে বিএনপি প্রথম দিনই জানালো রাজনীতি ছাড়া শমসের মবিনের ব্যক্তিগত বিষয়, সুর পাল্টেছেন তারাও। এখন দাবি করছে সরকারের চাপের মুখেই নাকি শমসের মবিনকে তার দল থেকে সরে যেতে হয়েছে।
এই দুই দাবির কোনোটিকেই কিন্তু হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। প্রথমেই আসি প্রথম দাবির বিষয়ে। অর্থাৎ `তারেকের ক্ষোভের কারণেই শমসেরের বিদায়`। রাজনীতির খেলাটাই এমন- নিজে যোগ্যতর হতে না পারলে বেকায়দায় ফেলতে হবে প্রতিপক্ষকে। এই চর্চাটা বাংলাদেশে খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায়। এরশাদের বিদায়ের পরই নতুন করে গণতন্ত্রর পথে হাঁটতে শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু সেই হাঁটাটা মসৃণ হয়নি কখনোই। বরং ক্ষমতার রাজনীতি বিভেদ বাড়িয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দুই সহযোদ্ধার মাঝে। সেই বিভেদ পৌঁছেছে বিদ্বেষে। এই বিদ্বেষের রাজনীতিই বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনার।
নির্দিষ্ট কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনোটিতে গণতান্ত্রিক চর্চা আছে কিনা- সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে বিস্তর। তবে মোটা দাগে বলা যায়, দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চার উপস্থিতি খুবই কম। এখানে দলীয়প্রধানদের ইচ্ছাটাই দলের সিদ্ধান্ত। বিএনপিতে তারেক রহমান দলীয়প্রধান না হলেও তার ভূমিকাটা অনেকটা সেরকমই। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ যাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করিয়ে এনে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন তার খুনিদেরই পুনর্বাসনে সহায়তা করেন শমসের মবিন। নীতিহীন` ব্যক্তি তাকে বলাই যায়। সত্যিই যদি মবিন সাহেবকে তারেক রহমান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে থাকেন- এটি নিঃসন্দেহে তার কৃতকর্মের ফল। নীতিহীনদের রাজনীতিতে না থাকাটাই ভালো। কিন্তু তারেক রহমান যে কারণে মবিন সাহেবকে ছুঁড়ে ফেলেছেন বলে কথিত হচ্ছে- সেটাও সুখের কিছু না। কারণ আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে লবিং-এর দায়িত্ব এখন অন্য কাউকে দেয়া হবে। তিনিও যদি ব্যর্থ হন? হওয়াটাই বরং স্বাভাবিক। অন্তত পৌনে দুই বছর ধরে রাজনীতিতে বিএনপি`র ব্যর্থতা তাই ইঙ্গিত করে।
২০১৪ সালের নির্বাচনপূর্ববর্তী সহিংসতা বুঝিয়ে দিয়েছে ক্ষমতার জন্য কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে বিএনপি-জামায়াত জোট। এত মানুষকে পুড়িয়ে মেরেও নির্বাচন ঠেকানো যায়নি। বরং ঘরে বাইরে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বিরোধী জোট। তাই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা আন্তর্জাতিক লবিংকে আরো জোরালো করতে চাইছে তারা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যে বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষের জন্য সুখের হবে না- সেই আশঙ্কা করা যেতেই পারে। কারণ ক্ষমতার জন্য যে জোট অসংখ্য মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে- তারা দেশকে কোথায় টেনে নামাতে চায় তা হিসেব করার জন্য জটিল কোনো অঙ্কের সমাধান দরকার নেই। এসব নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে কোনো ভাবনা না থাকলেও মবিনের বিদায়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ঠিকই।
শমসের মবিন চৌধুরী মাঠের রাজনীতিবিদ ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। নীতি নির্ধারণে তার ভূমিকাও নাকি ছিলো যথেষ্ট। তার শূন্যতা দুইদিনেই পূরণ হওয়ার নয়। অন্তত এই মুহূর্তে তা পূরণ করার মতো উপায় বিএনপি`র নেই। সেই হিসেবে দলটি খুব একটা স্বস্তিতে নেই বলা চলে। আবার তার এই পদত্যাগ বিএনপি`র অন্য নেতাদের মাঝেও ভিন্ন ধরনের বার্তা দিচ্ছে। কারণ এমনিতেই বিএনপি`র বেশিরভাগ নেতা মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হন না খুব একটা। তার উপর টানা কয়েক বছর ধরে তাদের কার্যক্রমও নেই বললেই চলে। এমন অবস্থায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সন্তুষ্ট রাখা সহজ হবে না তাদের পক্ষে। সেক্ষেত্রে অস্থিরতা, অস্বস্তি তাদের ভালোই পেয়ে বসতে পারে। এর ফল হতে পারে আরো ভয়াবহ।
সহিংসতা চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে হেরে গেছে বিএনপি। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর দলের ভেতর থেকে একটা ধারণা দেয়া হয়েছিলো, এই সরকার বড়জোর দুই বছর টিকবে। এর মধ্যে তাদের একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাধ্য করা যেতে পারে। মূলত সেই লক্ষ্যেই প্রথম বছরটিতে দেয়া সহিংসতা কিংবা অহিংস কর্মসূচিতেও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। উল্টো আওয়ামী লীগ সরকার তার উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ডের প্রচারণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে একটা বুঝ দিতে পেরেছে। এমন অবস্থায় সরকার মনে করছে, তাদের বেকায়দায় ফেলতে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড এবং হোসনি দালানে হামলার পেছনে বিএনপি জড়িত। সে ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপের মধ্যে আছেন দলটির নেতা। নানামুখি এই চাপ সামলানো তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি?
এবার যাই দ্বিতীয় দাবির বিষয়ে। অর্থাৎ সরকার কি সত্যিই চাপ দিয়ে শমসের মবিন চৌধুরীকে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করিয়েছে? প্রতিপ্রক্ষকে দুর্বল করতে তার ঘর ভাঙ্গার কাজ অনেকেই করে থাকে। এর আগেও বিএনপির দুই সংসদ সদস্যকে ভাগিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। ঠাঁই দিয়েছিলো মন্ত্রিসভায়। তাতে অবশ্য বিএনপি`র ক্ষতি হয়নি খুব একটা। বরং ভাঙ্গাভাঙ্গির এই খেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আওয়ামী লীগের বর্তমান মিত্র এরশাদ। তাদের জাতীয় পার্টি ভেঙ্গেছে চার দফা। অবশ্য ভাঙ্গাভাঙ্গি কিংবা লোক ভাগানোর রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন জিয়াউর রহমান। এভাবেইতো বিএনপিকে গুছিয়েছিলেন তিনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কি সত্যি সত্যিই শমসের মবিন চৌধুরীকে বিএনপি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে? সরকারের দাবি অনুযায়ী বিএনপি যদি দেশবিরোধী চক্রান্তে জড়িত থাকে- সেক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ আওয়ামী লীগ এবং তার সরকার বহু আগেই থেকেই দাবি করে আসছে, দেশবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। আর বিএনপি`র আন্তর্জাতিক লবিং যেহেতু মবিন সাহেব করে থাকেন- তাকে বিপজ্জনক মনে করতেই পারে সরকার। এ কারণে হয়তো তাকে চাপ দিয়ে নিষ্ক্রিয় করার একটি কৌশল নেয়া হয়েছে।
কিন্তু এভাবে চাপ দিয়ে প্রতিপক্ষকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেয়া গণতান্ত্রিক চর্চা হতে পারে না কোনোভাবেই। বরং পরমত অসহিষ্ণুতাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এমনিতেই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দমন পীড়ন, বাক স্বাধীনতা হরণ, ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু অভিযোগ আছে। সেগুলো তর্কসাপেক্ষ। তার উপর যদি সরকার রাজনৈতিকভাবে জয়ী হওয়ার জন্য বিরোধী শিবিরের কাউকে জোর করে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয় সেটি ভুল বার্তা দেবে বৈকি। এই বার্তা দেশের মানুষ যেমন পাবে, একইভাবে পাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন। বিশ্বায়নের এই যুগে পুরো বিশ্বকে পাশ কাটিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। সেটি করে থাকলে সরকার নিশ্চিতভাবেই বড় ভুল করেছে। সেই ভুলের খেসারত এদেশের মানুষকেই না দিতে হয়। মোদ্দা কথা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছাতেই হোক আর সরকারের চাপেই হোক- এভাবে হঠাৎ করে কারো রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ায় ভালো কিছু হতে পারে না। এবং সেই সরে যাওয়ার পর দুই পক্ষ যেভাবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছে- তাতে তিক্ততা যেমন বাড়ছে- সাধারণ মানুষের সামনেও তৈরি হচ্ছে অস্বচ্ছ একটি আবহ।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]
এইচআর/এমএস