ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঊর্ধ্বমুখী শেয়ার এবং কিছু সতর্কতা

সম্পাদকীয় ডেস্ক | প্রকাশিত: ০১:০৭ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২০

ড. মো. বখতিয়ার হাসান
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই মন্দাভাব চলছিল। করোনার কারণে বাজারে মন্দাভাব আরও ত্বরান্বিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে, বাজার কর্তৃপক্ষ লেনদেন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৩১ মে থেকে বাজারে লেনদেন আবারও চালু হয়। দীর্ঘ দিনের মন্দাভাব কেটে বিগত প্রায় দেড় মাস ধরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের জন্য এটি অবশ্যই ভালো খবর।

অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন যে, বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, আমি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ, বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটি বলার সময় এখনও হয়নি। ২০১১ সালের বাজার ধসের পর, বেশ কয়েকবার এভাবে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু কোনটিই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বরং কিছুদিন (একমাস বা দুইমাস বা তারও একটু বেশি) বাজার চাঙ্গা থাকার পর আবার মন্দা অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল। কিছুদিন এভাবে বাজার বাড়তে থাকলে, বাজার সংশ্লিষ্টদের সবাই এমনভাবে এটিকে প্রচারণা করতে শুরু করে যে, এই বুঝি বাজার ২০০৯-১০ এর মত বুম হয়ে গেল। ন্যাড়া বেলতলায় একবার গেলেও, আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বারবার এই ফাঁদে পড়ে কত যে পুঁজি হারিয়েছেন এবং সর্বস্বান্ত হয়েছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। যার দরুন, ২০১১ সালের পর বাজার কখনও স্থিতিশীল হয়নি।

বাজারের বর্তমান এই ঊর্ধ্বমুখী মূলত কাম্য ছিল। কেননা, দীর্ঘ দিন বাজারে মন্দাভাব থাকার কারণে অধিকাংশ শেয়ারের দাম তাদের নীট আসেস্ট ভালুর (এনএভি) অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল। এমন কি, প্রায় সব মিউচুয়াল ফান্ডের মূল্য তাদের ফেস ভালুর নিচে অবস্থান করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় কখনোও শেয়ারের মূল্য তার এনএভি বা ফেস ভালুর নিচে (অবমূল্যায়িত) বেশী দিন থাকতে পারে না। বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত ছিল। এখন নুতন কমিশন দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশকিছু ভাল উদ্যোগ নেওয়ায় বাজারের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কিছুটা ফিরতে শুরু করেছে। বাজারের বর্তমান এই ঊর্ধ্বমুখী মূলত মূল্য সংশোধনের (অবমূল্যায়িত থেকে ভারসাম্য মূল্য) কারণে হচ্ছে। তবে, ঊর্ধ্বমুখীর আরও কয়েকটা কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে।

•কালো টাকা সাদা করাঃ যাদের প্রচুর পরিমানে কালো টাকা আছে এবং যারা এইসব কালো টাকা বিদেশে পাচার করে থাকে, তারা করোনার কারণে এখন সেটি করতে পারছে না। ফলে, তারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে তাদের কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা করছে। যার কারণে সম্প্রতি বাজারে লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
•করোনার কারণে দেশের বাবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব থাকায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণদান কার্যক্রম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ফলে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অলস তহবিল শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছে।
•এছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একই কারণে তাদের অলস অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছে।
•ব্যাংকের আমানতের সুদের পরিমাণ কমে যাওয়ায়, অনেকেই শেয়ার বাজারে ঝুঁকছে।
•ফ্লোর প্রাইসও (সর্বনিম্ন মূল্য) বর্তমান এই ঊর্ধ্বমুখী জন্য সহায়ক হয়েছে।

এতদিন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার জন্য আস্থা বা পরিবেশ কোনটিই বিনিয়োগকারীরা পাচ্ছিলেন না। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার কিছুটা যে সঞ্চারণ হয়েছে তা সম্প্রতি বাজারে লেনদেনের ক্রমবর্ধমান অবস্থা দেখেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, দীর্ঘদিন পর শেয়ার বাজার যে ইতিবাচক ধারাই ফিরেছে এটাই বড় কথা। কিন্তু, এই ধারাটা যেন স্থিতিশীল হয়। অনেকেই মনে করেন বাজার সবসময় ঊর্ধ্বমুখী থাকলেই ভালো। কিন্তু, কোন যুক্তিক কারণ ছাড়া বাজারের দীর্ঘদিন ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী কোনটাই ভালো না। বাজারের উত্থান-পতন অবশ্যই থাকবে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নিয়মে হবে। আসলে দীর্ঘমেয়াদে বাজারের স্থিতিশীলতা বেশি কাম্য। এতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবেন না। আর্থিক বাজার বিশেষ করে শেয়ার বাজার সম্পূর্ণভাবে বিনিয়োগকারীর আস্থার উপরই দাঁড়িয়ে থাকে। কোনভাবে সেই আস্থার বিন্দুমাত্র ত্রুতি ঘটলেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যাবে।

এমতাবস্থায়, বাজারের এই বর্তমান ধারা দীর্ঘ সময়ে ধরে রাখাই বাজার কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ম্যানিপ্যুলেটর, স্পেকুলেটর, জুয়াড়ি বা সুবিধাবাদী যারা আছেন তারা এখনও বাজারে তৎপর। তাদেরকে ঠিকমত মনিটর করতে না পারলে, বাজার আবারও অস্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজার কর্তৃপক্ষ উভয়কেই সতর্ক থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে উভয়ের জন্যই কিছু সতর্কবার্তা ও পরামর্শঃ

সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্যঃ
•নিউজ বা রিউমার ভিত্তিক বিনিয়োগ করা যাবে না। সবসময় ভালো মৌল ভিত্তিক শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। মৌল ভিত্তিক বলতে যেসকল কোম্পানির ইপিএস, নীট ক্যাশ ফ্ল ও নাভ ভালো, নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়, পিই রেশিও কম, এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির শেয়ার। খারাপ মৌল ভিত্তিক শেয়ারে যত ভালো নিউজই থাকুক, সেটাতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, বিশেষকরে যারা নতুন বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগ না করাই শ্রেয়।
• যারা নতুন বিনিয়োগকারী তাদের কোন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী বা মার্চেন্ট ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী বিনিয়োগ করা তবে সেটা অবশ্য রিউমার ভিত্তিক যেন না হয়। মিউচুয়াল ফান্ডেও বিনিয়োগ করতে পারে।

বাজার কর্তৃপক্ষের জন্যঃ
•বাজারকে স্বাভাবিক নিয়মে চলতে দিতে হবে। অযথা হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কেউ রিউমার ছড়ায়ে বা ইনসাইড তথ্যের মাধ্যমে বাজারকে ম্যানিপ্যুলেট করে অস্বাভাবিক লাভ না করে। বাজারে যেই অনিয়ম করবে তাকেই শাস্তির আওতায় নিয়ে আস্তে হবে। সবার জন্য সুষম প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে। না হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।

•বাজার যেহেতু ইতিবাচক ধারায় এসেছে, সেহেতু এখনই সময় বাজারের মৌলিক বিষয় নিয়ে কাজ করা। বাজারের গভীরতা বাড়ানো, বাজারকে আরও শক্তিশালী করা ইত্যাদি। সেই জন্য চাহিদা এবং যোগান উভয়ের দিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের মোট জনগণের খুবই ক্ষুদ্র অংশ শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত। এখনও অনেক লোক শেয়ার বাজার অন্তর্ভুক্ত হয়নি এবং তারা বাজার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। অনেকেই আবার এটাকে ফটকা ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করে। ফলে, যারা ধার্মিক বিনিয়োগকারী তারা শেয়ারে বিনিয়োগ করতে চায় না। যদিও ইসলামিক সূচক চালু করা হয়েছে, কিন্তু প্রচারণার অভাবে সেটি খুব বেশি মানুষকে আকর্ষিত করতে পারেনি। আমেরিকা, ইউরোপ, মিডিল-ইস্ট, মালয়েশিয়া, চায়না, ভারতসহ অনেক দেশেই ইসলামিক সুচক চালু আছে এবং ধীরে ধীরে সেখানে জনপ্রিয় হচ্ছে। কাজেই, ভালো করে প্রচারণা করলে এটি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হতে পারে। বিনিয়োগকারীকে সচেতন ও আকৃষ্ট করতে ২০০৭-১০ এর দিকে জেলায় জেলায় বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা হত। সেটা আবার চালু করা যেতে পারে। এতে কিছুটা হলেও বাজারে চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

•অপরদিকে, যোগানের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ার বাজারে নিয়ে আসতে হবে। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন বিভিন্ন করপোরেশন ও কোম্পানি সেগুলোকে বাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। সরকার অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন পড়বে। করোনার কারণে এখন সারা বিশ্বেই মন্দাভাব চলছে। এমতাবস্থায়, প্রকল্পের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা সরকারের জন্য কঠিন হতে পারে। শেয়ার বাজারে বন্ড, বিশেষকরে সুকুক (ইসলামিক বন্ড) ছেড়ে অর্থের সংস্থান করলে একদিকে সরকারও লাভবান হবে, সেইসঙ্গে শেয়ার বাজারের যোগানও বৃদ্ধি পাবে। আবার বন্ড মার্কেটেরও উন্নতি হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। না আসতে চাইলে, আইন করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অনেক গ্রুপ অফ কোম্পানি আছে যেগুলো এখনও বাজাতে লিস্টেট হয়নি, সেগুলোকেও নিয়ে আসতে হবে। ভালো ও বড় কোম্পানির পরিমাণ বেশি হলে ও বাজারের আকার বড় হলে, ম্যানিপ্যুলেশন অনেকটাই কমে যাবে।

•পোর্টফলিও ডাইভারসিফিকেসান এর জন্য বাজারে প্রোডাক্ট ক্যাটাগরি বাড়াতে হবে। শেয়ারের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। বন্ড, ইসলামিক বন্ড, ইনডেক্স ফান্ড ও মিউচুয়াল ফান্ড চালু করা যেতে পারে। ডেরিভেটিভসও চালু করা যেতে পারে, তবে এখন নয়।
•যেহেতু মানি মার্কেট দ্বারা শেয়ার বাজার প্রভাবিত হয়, সেহেতু বাজার কর্তৃপক্ষকে অবশ্য এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং কিভাবে মানি মার্কেট ও ক্যাপিটাল মার্কেট এর নীতিমালার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটানো যায় সে বিষয়ে কাজ করতে হবে।
•পূর্বে যে কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়েছিল সে কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে যেন বাজার আবারও অস্থিতিশীল না হয়।
পরিশেষে, বাজার কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সর্বদা সচেতন থাকতে হবে, যাতে বাজারের এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে। প্রয়োজনে সার্ভিলান্স ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করতে হবে। আশা করছি, এইবার শেয়ার বাজার সত্যিকার অর্থেই ঘুরে দাঁড়াবে।

লেখক : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এর ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ।

এইচআর/এমকেএইচ