শুধু ডিজি নয়, বদলাতে হবে সিস্টেম
সাধারণ সময়ে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কে সেটাই জানে না। কিন্তু এখন সময়টা অস্বাভাবিক। করোনার কারণে সবার নজর এখন স্বাস্থ্যখাতের দিকে। আর স্বাস্থ্যখাতের কেন্দ্রে অবস্থান স্বাস্থ্য অধিদফতরের। অধিদফতরের মধ্যে আবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ হলো সবকিছুর কেন্দ্রে। তাই স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেবা শাখার মহাপরিচালক এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ পদ। সারাদেশের সবার নজর তার দিকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদত্যাগও গণমাধ্যমের শিরোনাম, নতুন মহাপরিচালকের নিয়োগও সংবাদ শিরোনাম। শুধু শিরোনামই নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালকের নিয়োগ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রীতিমতো তুলকালাম হয়ে গেছে। মিডিয়ারও একটা বড় শিক্ষা হলো সেদিন।
বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই ফিসফাস, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ডিজি হচ্ছেন অধ্যাপক এনায়েত হোসেন। এটিএন নিউজের একাধিক রিপোর্টারও প্রায় কনফার্ম করলেন। ডেস্ক ব্রেকিং নিউজ লিখে তৈরি। বললেই ফায়ার করবে। কিন্তু নিউজরুমের দায়িত্বে থাকা শহিদুল আজম বললেন, সরকারি প্রজ্ঞাপন না পেলে তিনি ব্রেকিং দেবেন না। একটু পর একে একে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল এনায়েত হোসেনের নাম নতুন ডিজি হিসেবে ব্রেকিং চালালো। এটিএন নিউজের নিউজরুমে হতাশা, ফিসফাস। কিন্তু শত প্রলোভনেও অনড় আজম। শেষ পর্যন্ত জয় হলো অভিজ্ঞতারই। এনায়েত হোসেন নয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ডিজি হিসেবে সরকারি প্রজ্ঞাপনে এলো অধ্যাপক খুরশীদ আলমের নাম। এটিএন নিউজকে ধন্যবাদ সবার আগে নিউজ ধরানোর ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে থাকার জন্য। আবারও আমরা শিখলাম সবার আগে ভুল নিউজ নয়, সঠিক নিউজ দেয়াটাই কৃতিত্বের।
অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম স্বাস্থ্যখাতে খুব পরিচিত নাম নয়। অনেকেই তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে নাম ঘোষণার পর মুহূর্তেই তার ঠিকুজিতে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারির অধ্যাপক খুরশীদ আলম কুমিল্লার ছেলে। পড়াশোনা করেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। দীর্ঘদিন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ছিলেন। এমবিবিএস পাস করার পর মাস ছয়েক নির্বাচন কমিশনেও চাকরি করেছেন। পরে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। পেশায় ডাক্তার হলেও নেশায় তিনি শিল্পী।
ওয়াহিদুল হকের ভাবশিষ্য খুরশীদ আলম ছায়ানটের কর্মী, ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। তার ইচ্ছা ছিল গান-বাজনা করে জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু নিয়তি আজ তাকে বসে দিয়েছে এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে কঠিন চেয়ারে। সমালোচনার ঝড়ের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে বাঁচা আবুল কালাম আজাদ কিন্তু করোনাভাইরাস আসার আগ পর্যন্ত বেশ সফল মহাপরিচালক হিসেবে পরিচিত ছিল। করোনা এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে। এক করোনাভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সব অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম, সিন্ডিকেটকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় আমাদের আরও অনেক ভালো করার সুযোগ ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনিয়ম আর সমন্বয়হীনতা তা হতে দেয়নি। এখন এই যুদ্ধের মাঝপথে এক সেনাপতি যখন পালিয়ে গেছেন, তখন সেখানে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে অধ্যাপক খুরশীদ আলমকে। তিনি কি পারবেন এই যুদ্ধে জিততে? পারবেন সমন্বয়হীনতা দূর করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে? পারবেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে? প্রশ্নগুলো সহজ। আর উত্তরও তো জানা।
শেষ প্রশ্নটা দিয়েই শুরু করি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক হিসেবে ১০/১২ জনের নাম আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু অধ্যাপক খুরশীদ আলমের নাম কোনো আলোচনায়ই ছিল না। তাকে খুব বেশি লোক চেনেন না। কিন্তু যারা তাকে চেনেন, তারা নিশ্চিত করেছেন, পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনে তিনি কতটা কী করতে পারবেন, তা এখনও নিশ্চিত নয়; তবে একটা ব্যাপার একশভাগ নিশ্চিত, তিনি কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবেন না। তার সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, কখনোই ছিল না। অধ্যাপক খুরশীদ আলমের মতো একজন নিভৃতচারী রাবীন্দ্রিক এবং শতভাগ সৎ মানুষকে খুঁজে বের করে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন, তার এবারের লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। অধ্যাপক খুরশীদ আলম দুর্নীতি করবেন না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু তিনি কি দুর্নীতি ঠেকাতে পারবেন?
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়। বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যখাতে রীতিমতো হরিলুট চলছে। ৯ লাখ টাকার জিনিস ৯০ লাখ টাকায় কেনা বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া কেবল স্বাস্থ্য অধিদফতরেই সম্ভব। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি তো আর একজন দুইজন ব্যক্তি করেন না। ধাপে ধাপে অর্থ বিলিবণ্টন হয়। অধ্যাপক এক্ষেত্রে দুইটি সম্ভাবনা। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলেন, কিন্তু অন্যদের দুর্নীতি ঠেকাতে পারলেন না। দেখেও না দেখার ভান করে রুটিন ওয়ার্কে কাটিয়ে দিলেন সময়। অথবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির শেকড় এত গভীরে, হুট করে আসা একজন ব্যক্তির পক্ষে তা উপড়ানো কঠিন। সে ক্ষেত্রেতার নিজেরই উপড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে প্রথম সম্ভাবনাটাই প্রবল। তিনি নিজে দুর্নীতি করবেন না, কিন্তু অন্যদেরটা দেখেও না দেখোর ভান করবেন। আর যদি সত্যি সত্যি স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেন, তাহলে তিনি কোটি মানুষের দোয়া পাবেন। কারণ স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির কারণে চিকিৎসাসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ গরিব মানুষ।
স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। সাধারণ প্রবণতার কথা বলেছি, কিন্তু আমার হৃদয়ের ভেতরের আরেকটা হৃদয় বলছে, খুরশীদ আলম হয়তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা মরণকামড় দিতে পারেন। খুরশীদ আলম সৎ মানুষ। আর সততার একটা সাংঘাতিক শক্তি আছে। সৎ মানুষ বোকা, আর বোকারা গোঁয়ার। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে খুরশীদ আলমের হারানোর কিছু নেই। পাওয়ার আছে অনেক অনেক কিছু। তিনি যদি তার সততার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে গোঁয়ারের মতো উত্তর-দক্ষিণ না দেখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখান, বদলে যেতে পারে স্বাস্থ্যখাত। আমি কখনো স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে বলি না। স্বাস্থ্যখাতের যা বরাদ্দ, সেটার সঠিক ব্যবহার হলে বাংলাদেশের সব মানুষই ন্যূনতম চিকিৎসাটা অন্তত পাবেন। আর স্বাস্থ্যখাত করে চিকিৎসার জন্য ভারত-থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরগামী মানুষের স্রোতটা একটু কমাতে পারলে বাঁচবে বৈদেশিক মূদ্রাও।
ডিজি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর সাংবাদিকদের সাথে প্রথম দেখাতেই খুরশীদ আলম প্রত্যাশিতভাবে দুর্নীতি নিয়েই কথা বলেছেন, ‘আমি বলব দুর্নীতির দায় আমাদের সবার। আমরা যদি শুধু সরকারের দিকে আঙুল তুলি, সেটা হবে সবচেয়ে বড় বোকামি। আমরা সবাই এই দুর্নীতির অংশ।’ এ নিয়ে দেখি অনেকে সমালোচনা করছেন যে, তিনি সরকারকে বাঁচাতে সরকারের প্রতি আঙুল তুলতে না করেছেন। কিন্তু তিনি ভুল তো কিছু বলেননি। আমরা নিজেরা সৎ থাকবো না, দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেবো, দুর্নীতি দেখলে প্রতিবাদ না করে এড়িয়ে যাবো, দুর্নীতিবাজদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেবো, তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করবো, মেয়ে বিয়ে দেবার সময় খোঁজ নেবো ছেলের উপরি আয় আছে কিনা; আর দুর্নীতির সব দায় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেবো; তা তো হয় না, হওয়া উচিত নয়।
কেউ ভাববেন না, আমি সরকারকে দায়মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছি। শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, প্রতিটি খাতেই এখন দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে গেছে। সরকারকে অবশ্যই কঠোর হাতে দুর্নীতি দমন করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দুর্নীতিটা কিন্তু আমি বা আপনিই করি। দুর্নীতিবাজরা তো মঙ্গলগ্রহ থেকে এসে পালিয়ে চাঁদে চলে যায় না। তাই বলছি, সামগ্রিকভাবে সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে একজন ব্যক্তির বদলে স্বাস্থ্যখাতের কিছুই হবে না, গোটা সিস্টেসটা বদলাতে হবে।
করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সমন্বয়। ওপরে মন্ত্রণালয় আর নিচে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী- এ দুয়ে সমন্বয়টা খুব জরুরি। অদৃশ্য করোনার সাথে লড়াইয়ে জিততে হলে আউট অব দ্য বক্স কোনো ভাবনা, সৃষ্টিশীল কোনো উদ্যোগ লাগবে। সাধারণ ভাবনায় হবে না। খুরশীদ আলম যদি ভাবেন, আমার আর ছয় মাস চাকরি আছে, কোনোরকমে পাড় করে দিলেই হলো; তাহলে তো তিনি সেই ঝাঁকের কইই। কিন্তু যে সুযোগ তিনি পেয়েছেন, তা অনেকে পায় না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে অনেকের উপকার হবে। তিনি প্রাতস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার রাবীন্দ্রিক ভাবমূর্তিটা ভালো, তবে সেটাকে যাতে কেউ দুর্বলতা হিসেবে না নেয়। প্রয়োজনে তাকে কঠোরও হতে হবে। কুসুমিত ইস্পাতের মতো। তাকে আপাতত গান বাজনা থেকে ছুটি নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতি জনগণের প্রত্যাশার বিপুল চাপ আছে। সেই চাপ সামলে তাকে কাজ করতে হবে। খুরশীদ আলম কাব্যিক মানুষ। তার পরিস্থিতিটা অনুধাবন করে তার জন্য সুকান্তের একটা কবিতা তুলে দিলাম-
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী-গদ্যময়ঃ
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
২৭ জুলাই, ২০২০
এইচআর/এমকেএইচ