স্বাস্থ্যসেবা অধিকার ও ডাক্তারদের সুরক্ষা
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের Mainstream Frontline Fighter হিসেবে ডাক্তাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংক্রমিতদের চিকিৎসা সেবা দিলেও অনাকাঙ্খিত অভিযোগ উঠেছে যে, কিছু ডাক্তার-নার্স পিপিই স্বল্পতা, মাস্কের গুণগত মানসহ বিভিন্ন কারণে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। এই অস্থির সময়ে এ ধরনের ঘটনা মানুষকে আরও বেশি অসহায় করে তোলে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য The Medical Practice and Private Clinic and Laboratories Ordinance-1982 এর ধারা ১১ অনুযায়ী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেসরকারি হাসপাতাল সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবেন। যদি কোন অনিয়ম ঘটে, তবে ১৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারেন। এছাড়া ৬ মাসের জেল ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা, এমনকি প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তিও জব্দ করতে পারবেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী অন্ন,বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান মৌলিক চাহিদা, মৌলিক অধিকার নয়! যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ চিকিৎসা না পেলে জীবন হুমকির মুখে পড়ে। কারণ অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী সকল নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, আর এইক্ষেত্রে হাইকোর্টে রিট করে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
যদি কোন ডাক্তার পেশাদারিত্বের অবহেলা করেন বা অস্বীকৃতি জানান, সেক্ষেত্রে Court of Medical Ethics এর ধারা ৫A অনুযায়ী একটি অভিযোগ BMDC বরাবর দেবেন এবং তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে Bangladesh Medical and Dental Council Act -2010 এর ২৩ ধারা অনুযায়ী সেই ডাক্তারের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারেন।
যদি চিকিৎসা প্রদানকালে ডাক্তারের অবহেলা জনিত কোন অঘটন ঘটে, তখন দণ্ডবিধি ৩০৪A অনুযায়ী ৫ বছরের জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। যেমন, আমেরিকায় মাইকেল জ্যাকসনের ভুল চিকিৎসার ঘটনায় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকে ২০১১ সালের ৭ নভেম্বর কারাদণ্ড দেয়া হয়। ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানী আইনের আওতায় সিভিল কোর্টে প্রতিকারের বিধান রয়েছে। তবে সর্বশেষ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর ধারা-২ অনুযায়ী চিকিৎসাসেবাকে এ আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এ আইনেরই ৫২-৫৬ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে।
শুধু কঠোর আইনের প্রয়োগ নয়, সকলের মন ও মগজের পরিবর্তন দরকার। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, We can't make any change in an overnight. পুরনো অভিযোগ রয়েছে যে, মফস্বল পর্যায়ে সরকারি পদায়নপ্রাপ্ত ডাক্তাররা থাকেন না! বিষয়টি সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ ধারণ করেছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রতিপালন না হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো যদি একটি উপজেলায় ইউএনও, এসি ল্যান্ড, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রকৌশলী, শিক্ষকসহ অন্যান্য সকল বিসিএস ক্যাডার ও কর্মকর্তাগণ স্থানীয় কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকেন, তবে কতিপয় সরকারি ডাক্তার কি আইনের ঊর্ধ্বে গ্রামের অসহায় গরীব মানুষদের জীবনের কি মূল্য নেই, যে জনগণের টাকায় আজকের ডাক্তার। সেবাই তো ডাক্তারের ধর্ম।
ইতিমধ্যেই অনেক ডাক্তার চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এমনকি জীবনও উৎসর্গ করেছেন, তারা জাতীয় বীর। এমনই বাস্তবতায় তাদের সুরক্ষার জন্য দাবি উঠেছে। এক্ষেত্রে তাদের আইনগত অধিকারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান না থাকায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক আইনজ্ঞ মনে করেন, 'বাংলাদেশ শ্রম আইন -২০০৬' এর ৭৮ ধারার শ্রমিকদের বিশেষ পোশাক ও সুরক্ষার বিধান স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এটা সম্ভব নয়, কারণ ২ ধারা বলা হয়েছে, শ্রমিক বলতে যারা কল-কারখানায় কাজ করেন তাদের বুঝানো হবে। তবে 'জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালা-২০১৩' এর দফা ২ এ নীতিমালার অধিক্ষেত্র বলতে শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠানসহ সকল কর্মস্থলকে বুঝানো হলেও চিকিৎসকদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিকার কষ্টকর। বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা হওয়ায় World Health Organisation এর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রজ্ঞাপনের দ্বারা তাদের সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, 'বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন' নামে একটি খসড়া আইন কয়েক বছর ধরে প্রস্তাবিত আছে। এই খসড়া আইনে সরকারি ডাক্তার প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না। এছাড়াও উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ অনুমতি ব্যতীত কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। আর এসকল বিষয় নিয়ে বিরোধিতার কারণে আজ পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি। উল্লেখ্য, ব্রিটেনে Health and Safety at Work -1974 আইনটি প্রণীত হয়েছে। আমেরিকাতে Health Security -1993 প্রণয়নের পাশাপাশি Violence Against Health Care Provider -1998 আইনটি নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতে 'চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন-২০০৮' প্রণয়ন, এমনকি নেপালেও ২০১০ সালে 'স্বাস্থ্য কর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন' প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও চিকিৎসকদের সুরক্ষা ও আইনগত নিরাপত্তা দিলে দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশেও সহানুভূতিশীল, মানবিক ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারেন।
আমাদের দেশেও মেধাবী স্বনামধন্য চিকিৎসকগণ আছেন। তথাপি অনেক ক্ষেত্রে গুণগত সীমাবদ্ধতা, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ায় চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তাই স্বাস্থ্যসেবা কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বিধায় নীতিনির্ধারণী পদ্ধতি পুনঃবিবেচনার দাবি রাখে বৈকি। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ইউরোপ-আমেরিকা গমন নিয়ে আমরা যত সমালোচনাই করিনা কেন যতদিন এদেশের ডাক্তারদের পেশাগত মানোন্নয়ন ও চিকিৎসা ব্যাবস্থা অত্যাধুনিক না করতে পারছি ততোদিন শুধু ভিআইপি নন দেশের গরীব মানুষটিও সঠিক চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে হলেও যাওয়ার চেষ্টা করবে আর বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ পাচার হবে। চিকিৎসার মান, পদ্ধতি ও ব্যবস্থার উপর আস্থা ডাক্তারদেরই অর্জন করতে হবে, আর সরকারকেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এইচআর/এমএস