এবার একটু করে দেখান প্লিজ
মন্দির ভাঙার উৎসব,শারদ উৎসব-চলে আসছে এদেশে জন্মাবধি। পরিমাণে কম, কিন্তু কত কম হলে সেটা সফল উৎসব কেউ সীমা বলে দেয়নি। আপাত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর কড়া পাহাড়া বজায় রেখে দর্শনীয় ও লোভনীয় এবারের দুর্গোৎসবও সফল সমাপ্ত হয়েছে। নিত্য ভাঙার ইতিবৃত্তে নজর দিয়ে অযথা মা লক্ষ্মীর মন খারাপের দায় কেউ নিতে চাইবে বলে মনে হয় না, নেয়নি। জলে ডুবিয়ে গতানুগতিক দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা গেছে। মা আরাধ্য আর তাঁর সন্তানগণ পাপবিদ্ধ । মুক্তি চেয়ে পাপমুক্ত হয়েছেন বিশ্বাসীগণ। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম তাই শক্তিশালী বিশ্বাস নির্ভর, শক্ত তার বন্ধন। আঘাতে ধর্মে চির ধরে না, দীর্ঘ অভ্যস্ত সত্য। কিন্তু কারা তবু কেন যে বারবার সেদিকে বিভেদের কামান তাক করেন, সেটা বের করা কিছু একটা দুরূহ ছিলো না। হাতেনাতে না ধরতে পারলেও কখনও লাভালাভের হিসেব মিলিয়ে তাদের পরাস্ত করার ইতিহাসও সেদিনের কথা মাত্র । ধর্ম মানেই যেহেতু পবিত্র বিশ্বাস, বিশ্বাসে আঘাত করতে নেই। মানুষ বিশ্বাস ভর করেই বাঁচে।
কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। সারা বিশ্বেই মন্দিরের দেবীর মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়, মসজিদের ভেতর ঢুকে মানুষ আক্রমণ হয়, গাড়ি ঢুকিয়ে হজের পথে পবিত্র হাজীদেরও হত্যা করা হয় – কে রুখে ? বাংলাদেশ যখন দেশ হিসেবে দাঁড়ায়,বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়, কিছু প্রাপ্তির দাবি,অর্জনের দাবিতে বিশ্বকে মাথা তুলে দেখায়- স্বাধীনতা লাগে, মন ভালো হয়। কিন্তু দাবির প্রেক্ষিতে দায় নেয়ার সক্ষমতাও স্বাধীন জাতির থাকতে হয়, সে প্রশ্নে সকলের স্বর হয় নিরব, নয় পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাউয়িতে বেলা পার। যা হবার হয়, হয়ে যায়। দেশ কিন্তু সংকটে পড়ে, সংকটে ফেলা হয়। কারা কখন কীভাবে ইত্যাদি প্রশ্নের চিন্তা যখন দুশ্চিন্তায় অগ্রসর হয়, ভয় হয়, খুব ভয়। বিশ্লেষণের বিষয়টা নিয়ে আলোচনার প্রাক্বালে ঘটনার উল্লেখ বাঞ্ছনীয়। গতকালই যোগ হলো নতুন এক সন্ত্রাসের সংযোজিত অধ্যায়- ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলা।
রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের হোসেনী দালানের পাশে আশুরার মিছিলে শক্তিশালী চারটি বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক আহত, আশঙ্কাজনক পঁচাত্তর, প্রাথমিকভাবে সানজু নামে একজনের মৃত্যু নিশ্চিত।প্রায় লাখের মতো মানুষ এখানে তাজিয়া মিছিল নিয়ে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক এমন সময় ১টা ৪৫ থেকে ২টার মধ্যে পরপর চারটি বোমা বিস্ফোরণ হয়। এতে অনেক মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হোসনি দালানের চারদিকেই ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বেষ্টনী। র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ছিলেন সতর্ক। এরই মাঝে দুর্বৃত্তরা ইমামবাড়ার ভেতরে শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের কাছে আগেই এ হামলার তথ্য ছিল এবং এর ছক করা হয়েছে বগুড়ায়।
ঘটনাস্থল সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, হাজার হাজার মানুষের মিছিলে জনে জনে তল্লাশি করা সম্ভব ছিল না। দুর্বৃত্তরা হযরত হাসান-হোসেনের ভক্ত ও সমর্থকদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সুযোগমতো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে দুর্বৃত্তরা। এই বোমাগুলো উপর থেকে মারা হয়নি। এগুলো দুর্বৃত্তরা ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে কৌশলে নিচের দিকে ছেড়ে দিয়েছিল। ফলে আহত ও নিহতদের সবার পায়ের দিকে বেশি স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী চক্র পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না, দেশের স্থিতিশীলতা চায় না, তারাই এ কাজ করেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জেএমবি কিংবা কোনও জঙ্গির সংশ্লিষ্টতা তারা এখনও পাননি। ঘটনার পরপরই সারাদেশের পুলিশ ও র্যাবকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ সূত্র জানায়, বোমার একটি স্প্লিন্টার নিহত সাজ্জাদ হোসেন সাঞ্জুর বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ফুসফুস ফুটো করে দিয়েছিল। যে কারণে তার মৃত্যু হয়। এছাড়া তার শরীর থেকে বোমার আরও দুটি স্প্লিন্টার বের করেন তারা। পিঠে ও পায়ে স্পিন্টার বিদ্ধ হলেও মাথায় কোনও আঘাত ছিল না।
প্রায় ১৩৩২ বছর আগের কারাবালার ঘটনা স্মরণ করে শুরু হয় গতকালকের তাজিয়া মিছিল। এতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়, যাতে মাতম ছিল ‘হায় হোসেন-হায় হোসেন’। “ইয়াজিদের বংশধরেরা এই হামলা চালিয়েছে। ইমাম হোসেনকে যারা হত্যা করেছিল, তারা এখনও আছে।” মিছিলে অংশগ্রহণকারী এক শিয়া মতাবলম্বী এ মন্তব্য করেছেন। মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই সুবাদে ওই তারিখ আশুরা বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে। কারো মতে, হিজরী ৬১ সনের ১০ মহররম ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বাহিনী কর্তৃক হজরত ইমাম হোসাইন রাঃ-কে যে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়, সেই হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণেই পালিত হয় আশুরা।
মহররমের ১০ তারিখ বা আশুরা আরো যেসব কারণে তাৎপর্যমণ্ডিত, তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ঘটনা সমূহ নিম্নরুপ-
(১) আল্লাহপাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।
(২) আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হজরত আদম আঃ-কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।
(৩) মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আঃ ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ১০ মহররম।
(৪)১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল তলে তুবে মরে আর হজরত মুসা আঃ বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির ওপর দিয়ে পার হয়ে যান।
(৫) হজরত ইউনুছ আঃ ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর ১০ মহররম নাজাত পেয়েছিলেন।
(৬) হজরত নূহ আঃ ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর ১০ মহররম নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।
(৭)হজরত ঈসা আঃ ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন শূলদণ্ড থেকে মুক্তি লাভের জন্য সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন ১০ মহররম।
(৮)হজরত ইয়াকুব আঃ তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ আঃ-কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পান ১০ মহররম।
(৯) ধৈর্য, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হজরত আইউব আঃ ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত থেকে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ১০ মহররম আকস্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করেন।
(১০) কাবাঘরের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংগঠিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কাজেই ইসলামের ইতিহাসে মহররম মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিভিন্ন কারণে অশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। প্রাক-ইসলামি যুগেও মহররমের ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। অফুরন্ত বরকত ও তাৎপর্যমণ্ডিত মহররম মাসে বহু নবী-রাসুল ইমানের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। কারবালাসহ অসংখ্য তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনা এ মাসে সংঘটিত হয়েছিল। ১০ তারিখ আশুরার সঙ্গে পুরো মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য হলো প্রাচীনকাল থেকে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসুলের শরিয়তে ১২ চান্দ্রমাসকে এক বছর গণনা করা হতো এবং তন্মধ্যে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব- এ পবিত্র চারটি মাসকে বরকতময় ও সম্মানিত মনে করা হতো। এ মাসগুলোকে ‘আশ-শাহরুল হারাম’ বা অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস বলা হতো। এ চারটি মাসে যেকোনো ইবাদতের সওয়াব বৃদ্ধি পায়। তেমনি এ সময়ে পাপাচার করলে এর ভয়াবহ পরিণাম ও কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। পূর্ববর্তী শরিয়তসমূহে এ মাসগুলোতে সব ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, মারামারি, খুনোখুনি প্রভৃতি নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু শিয়া মিছিলে হামলাকারীদের জ্ঞান উদ্রেক হয়নি, তারা নিষ্ঠুর খুনের নেশায় মাতোয়ারা হয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে যে দুর্বিষহ অবস্খার সৃষ্টি হয়েছে,বলাই বাহুল্য। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বাইরের দুনিয়ার চাপ সামলে নিয়ে দেশ যখন একটা গতির সম্মুখে হাজির,ষড়যন্ত্র তখন পথ রোধ করে দাঁড়ায়, উন্নয়ন হোঁচট খায়। গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়,দুর্বলতর হয়ে পড়ে। দিকহীন হয়ে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক চিড় ধরে। নিরাপত্তার প্রশ্নে, জীবনের প্রশ্নে কে আর ছাড় দিতে চাইবে। দেশ পাহাড়ার দায়িত্বে থাকেন যারা, জবাব দিতে হয়। তারা জবাব দিচ্ছেনও। দিনের পর দিন মানুষ বিশ্বাসও করেছে। এখন সময় ক্ষীণ হয়ে আসছে, করে দেখানো ছাড়া বিশ্বাস জাগানো কঠিন। সরকারে আর বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি বাকযুদ্ধের সময় এটা নয়।
ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া আবারও এদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। ব্যাপারটি মোটেও সুবিধার নয়। যদি ষড়যন্ত্রও হয়, সেই মুখোশ উন্মোচন করা হোক। ধরা হোক, প্রমাণ হোক। কিন্তু কাজটি মোটেও কঠিন নয়। ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশেকে অনিরাপদ বলে ক্রিকেট খেলতে না এসে বিদেশি হত্যাকাণ্ডের মত বিষয় পরপর দেখানোর পরিকল্পিত প্রক্রিয়া ভয়ের বৈকি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নস্যাতের ইতিহাস যেমন চলছে, সে ইতিহাস ভাঙার প্রক্রিয়াও সফলভাবে হয়েছে, হচ্ছে। সরকার পিছপা হয়নি। জঙ্গি দমনেও আমরা আস্থা রাখতে চাই। বিরোধী দলকেও সরকার আস্থায় নিয়ে আসুক। একক সমস্যা সমাধানের দিকে দেশ যাচ্ছে, বলা কঠিন। পরতে পরতে বাইরের জঙ্গি দমনে সরকারের আগ্রহ যতটা, মনের ভিতরে জঙ্গি দমনে প্রচেষ্টার ঘাটতি আছে বৈকি। বিরোধী দল দমন পীড়ন করার মাত্রাও ঠিক রাখতে হয়, সীমার মধ্যে গণতন্ত্র থাকলে দ্রোহের আগুন কম দেখতে হয়। কিন্তু লাগাম টানবার সময় ফুরিয়ে যায়নি। হাতছাড়া হয়ে গেলে কিন্তু গেলো। ক্ষমতার মসনদ কোম্পানির দিকেই না চলে যায়!
ব্যক্তি বাংলাদেশকে রাজনৈতিক চাটুকারিতার বাইরে এসে দলমত নির্বিশেষে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বলছি।বুদ্ধিজীবীরা চাটুকারিতা কমালে রাজনতিকরা চোখে ভালো দেখতে পাবেন, আশা করি। না দেখলে কি আর শাসন হয়। এই যে হযরত ইমাম হোসেন কে স্মরণ ও সম্মাণ করার প্রক্রিয়া, এটাও তো একটা সিগন্যাল বটে। শত্রুপক্ষের হাতে দেশ গেলে ধর্মের কত ক্ষতি, কত ক্ষতি মানুষের, দেশের। স্বাধীনতারও তো একটা অর্থবহতা থাকা উচিত। ক্ষমতার বাইরেও ক্ষমতা আছে, এটা বুঝতে না পারলে,ত্যাগের মর্সিয়া ক্রন্দন শুধু মিছিলেই সীমায়িত থাকে, মনের ক্ষমতা বাড়ায় না। আল্লাহ,বাংলাদেশকে ইয়াজীদের হাত থেকে রক্ষা করুন, আমিন। একথা বললেই শেষ হয়ে যায় না। বাকি কাজটুকুও করতে হয়। কারা কী করছে, কী জন্য করছে এটা বারবার বলে বুঝানোর দরকার নেই, এবার একটু করে দেখান, প্লিজ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এইচআর/পিআর