স্ববিরোধী আচরণে মনুষ্যত্ব যখন দিগম্বর
গানের প্রথম কলি দিয়ে শুরু করি ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। এখানে গানে লোকগীতি-বাউল-ভাটিয়ালী গানের কিংবদন্তি ওস্তাদ শাহ আব্দুল করিম আক্ষেপ করে বর্তমান সমাজব্যবস্থা, আমাদের মনের দৈন্যদশা-সরব-নীরবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে দায়ী করেছেন। গানটি হিট হয়েছে তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সবাই গেয়ে থাকেন। হিট গান! গায়ক-যন্ত্রীদের তাল-লয়ের দুর্দান্ত বাদন! তালি-শিস-তুড়িতে শ্রোতা একাকার। গান শেষ তো সবই শেষ! শ্রোতা-দর্শক কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দর্শক-স্রোতা প্রতিক্রিয়ায় বলেন ‘শিল্পী বেশ গেয়ে জমিয়েছেন’। স্রেফ এটুকু পর্যন্ত! গানটি শুনে কতজন হৃদয়ে ধারণ করেন- ‘এ পর্যন্ত কোনো গবেষণাধর্মী পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি’।
প্রত্যেক প্রাণীরই আচরণগত বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ মানুষের মতো, সাপ সাপের মতো, বাঘ বাঘের মতো। সব প্রাণী তাদের আচরণ এ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে। একমাত্র মনুষ্য প্রজাতি ধরে রাখতে পারেনি! এঁনাদের মন কখন কী বলে? একমাত্র উনিই জানেন বোঝেন! এ প্রজাতির কাছে সত্য-মিথ্যা নিরূপণের মেশিনও বিকল হয়ে যায় বারবার। এ মানব প্রজাতি করতে পারেন না! এমন কোনো কাজ নেই। ভাবতে পারেন না! এমন কোনো ভাবনা নেই। এ প্রজাতি কখনও মিছরির ছুরি-আলুর দোষ-ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি। খেয়ে-দেয়ে বেঁচে আছি!
এ দুর্বোধ্য রহস্যঘেরা জটিল মানব প্রজাতির স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে অনেক নৃ্-বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক আবেগ-বেগের সম্মোহক সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন। কিন্তু কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি! সত্যি বলতে কোনো দ্বিধা নেই; আমি নিজেই এ প্রজাতিভুক্ত হয়ে সবসময় ভয়ে থাকি। কখন-কোথায়-কীভাবে এ প্রজাতি হতে নিরাপদ থাকব? সে চিন্তায় বিভোর থাকি। আমি এখন অ্যানাকোন্ডা-বাঘ-সিংহ-হিংস্র শ্বাপদকে ভয় পাই না, ভয় পাই স্বগোত্রের এ প্রজাতিকে। এ প্রজাতি পোষ মানে না, কৃতজ্ঞ হয় না, বিশ্বাসী হয় না, সেকেন্ড সেকেন্ড গিরগিটির মতো সব পাল্টিয়ে নেয়।
চরম আদর্শবান পাবলিক ফিগার, মোটিভেশনাল স্পিকার যখন উত্তরাধিকার নারীবাদ-মার্কসীয় নারীবাদ-পরিবেশ নারীবাদ-নারীবাদী যৌনযুদ্ধ সামলিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে বুক চিতিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে নারীদের জন্য এ বুঝি কিছু একটা করতে যাচ্ছেন! রাতের নিশিকুটম্ব হয়ে- ঢেঁকুর-মদের প্যাক-হাই তুলে বউ পিটিয়ে নারীবাদ চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নতুন আদর্শের বুলি আওড়িয়ে চলেন। আদর্শ বাবা-সন্তানের পাঠে ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’ জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে মোবাইলে নিষ্পাপ সন্তানের বুলিতে ‘বাবা তো বাড়ি নেই’ বলিয়ে সন্তানের আদর্শ বাবার বারোটা বাজিয়ে দেন।
অগণিত যুবতী-কিশোরী-কুলবধূর সর্বনাশ ঘটিয়ে অক্ষতযোনি পাত্রী খোঁজা চরম পুরুষবেশ্যা যখন হবু স্ত্রীর জৈব অর্গান কল্পনায় হা-পিত্যেশ করেন! ‘তবুও আমি সতী পাত্রী’ গুন গুন করে গান ধরেন ‘মন দিয়া তোর মন পাইলাম না, দুঃখ এই অন্তরে রে, আর আমি মন দেব কারে?’ হবু অক্ষতযোনি পাত্রী ও ভণ্ডপ্রেমিক পুরুষবেশ্যা চেনেন।
দেশের সরকারি-বেসরকারি ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড-ফোর্থ ক্লাস সেবকগণ জনকল্যাণ নিয়ে মাঠেঘাটে বন-বাদাড়ে কত যে কষ্ট করেন! তা ভুক্তভোগীই জানেন! এঁনাদের হাসি-কাশি-ঝোল পাদ-ঠাস পাদ-ফুস পাদ কখন আসে! কখন যায়! কারও বোঝার সাধ্য নেই। জনগণ না বোঝার আগেই এঁনারা বনে যান রাজা-মহারাজার নাতি। শ্বশুড়-শাশুড়ি-ভায়রা-শ্যালকের দানে মাছ-সরিষা-শাক চাষের বাহারি কুম্ভিলক ছেলের হাতে মোয়া ভোলানো হিসেবে এঁনাদের কোটরাগত চোখ-গাল চর্বি প্রলেপে আস্তে আস্তে ভরে যায়। কোমড় শক্ত হয়ে স্টিলনেস স্টিল হয়ে টাং-টাং করে বাজে। ধরা-সরা জ্ঞানের তোয়াজ না করে দ্রুত গড়ে তোলে বহুমুখী বাণিজ্যালয়। যুক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন সিন্ডিকেটে! এঁনারা এখন অফিস-চেম্বার করেন নিজের তাগিদে! অফিস-চেম্বার একান্ত ভাবনায় নিজের করে নেন। এঁনারা প্রজাতন্ত্রের চাকর/সেবক তা ভুলে কৃতঘ্ন হয়ে ‘যেখানে যেমন আমি হয়ে পড়ি তেমন’ হয়ে সরবে ঠাস পাদ-ফুস পাদ না দিয়ে ঝোল পাদ দিতে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে করোনা অতিমারি সংকট মোকাবিলা করে চলেছি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে এ অতিমারি সংকট মানবিকতা দিয়ে মোকাবিলা করে চলেছে। সকল জনগণই প্রজাতন্ত্রের অংশীদার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা সংকট মোকাবিলায় এত উপদেশ! মানবতার জয়গান! চোখে পড়ার মতো। যা রীতিমতো বিস্ময়কর! আবার লাশ দাফনে বাধা- করোনা রোগীদের ফেলে দেয়া, এমন কী! মাতা-পিতা-সন্তান-পরিজনকে অমানবীয় আচরণে ছুঁড়ে ফেলা, একঘরে করা, ময়লা ছুঁড়ে করোনা রোগীদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া।
সবাইকে একদিন মরতে হবে। করোনাসংকট নিয়েই আমাদের সামনের পথচলা। হা-পিত্যেশ করে কোনো সমাধান আসবে না। সচেতনতা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে করোনা আক্রান্তরা সবাই আমাদের আপনজন। মানসিক প্রশান্তি-মানবীয় আচরণ রোগীদের বেশি প্রয়োজন। মানসিক প্রশান্তি-সমর্থন আমাদের আপনজন-প্রতিবেশী-সমাজে আক্রান্তদের দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। আমরা প্রায়শই স্ববিরোধী কাজ করি। উল্টো পথে হাঁটি। নিজেই উপদেশ দিই! পালন করি না। এ মহামারি সংকটে আমাদের স্ববিরোধী ভাবনায় মনুষ্যত্ব যাতে দিগম্বর হয়ে পালিয়ে না যায়- মুষ্টিবদ্ধ ঐক্যের বাতাবরণ নিয়ে সবাইকে সামনে এগিয়ে এসে অমানবীয় দিগম্বর প্রথা বন্ধ করা জরুরি।
লেখক : কবি ও পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।
এইচআর/বিএ