ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আক্রান্ত না হয়েও ‘করোনা ট্রমাটাইজড’ হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল | প্রকাশিত: ১০:৫৪ পিএম, ১৪ জুন ২০২০

‘‌নে বাবা এ ওষুধগুলো খেয়ে নে।’ মোবাইলফোন থেকে চোখ সরাতেই দেখি ডি রাইস, সিভিট, ‌ভিটা‌মিন-ই ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটসহ কয়েক প্রকার ওষুধ হাতে দাঁড়িয়ে আমার বাবা। এগুলো কী জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শরীরের ইমিউনিটি বাড়াবে।’ তিনি তার পরিচিত এক চিকিৎসকবন্ধুর কাছ থেকে এগুলো নাম নিয়ে পরিবারের সবার জন্য কিনে এনেছেন। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কাজে বাইরে যেতে হয়- এ নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। বাইরে থেকে এলে পিপিই খুলে রাখা এবং গোসল করে তারপর সবার সাথে কথাবার্তা বল; এগুলো নিশ্চিত করতে পরিবারের কর্তাব্যক্তি হিসেবে তিনি সদাতৎপর। জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয় এমনটা শোনার পর ছেলেকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘অফিসকে বলে দাও, ঘরে বসে যতটুকু পারো ততটুকুই কাজ করবে। তারা যদি মনে করে বেতন বন্ধ রাখবে তাতেও এ মুহূর্তে আপত্তি করোনা। আগে জীবন তারপর জীবিকা।’

গত তিন মাসে করোনাকালে আমার নয় বছরের শিশুকন্যাটিও ‘খুদে সাংবাদিক’ হয়ে গেছে। প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত হেলথ বুলেটিন শুরু হয়। এ কথা বাবাকে মনে করিয়ে দেয়া এবং রেকর্ডার নিয়ে রেকর্ড করে বাবার হাতে পৌঁছে দেয়া এখন তার নিয়মিত কাজ। এ কাজে পিছিয়ে নেই নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেটিও। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগওয়ারী আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান যোগ-বিয়োগ করে বাবাকে সহায়তা করছে। স্ত্রীর মুখেও প্রশ্ন এই আজকে অমুক হাসপাতালে অমুকে মারা গেছে। তুমি বাইরে যাও, আমার খুব দুশ্চিন্তা হয়। ছেলেমেয়েরা ঘরবন্দি থাকতে থাকতে কেমন যেন হয়ে গেছে।

এমন দুশ্চিন্তা শুধু আমার পরিবারের নয়, রাজধানীসহ সারাদেশের অসংখ্য পরিবারের। অনেক পরিবারের সদস্যরা নিজেরা করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হলেও গত তিন মাসেরও বেশি সময় যাবৎ করোনা আক্রান্ত ও মৃতের খবর শুনতে শুনতে ‘করোনা ট্রমাটাইজড’ হয়ে গেছেন। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে তারা।

কারণ বর্তমানে প্রতিদিনই খবরের কাগজ, অনলাইন নিউজ পোর্টাল কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চোখ রাখলেই ভেসে আসে করোনাভাইরাস আক্রান্ত এবং মৃতের খবর। শুরুর দিকে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত এবং মৃত্যুর খবর অনিমিত থাকলেও এখন চারদিকে কেবলই মৃত্যু সংবাদ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিলে নাম লিপিবদ্ধ হচ্ছে প্রভাবশালী মন্ত্রী, স‌চিব, শিল্পপতি, ব্যাংকার, গণমাধ্যমকর্মী ও চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত কিংবা করোনার উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভিড় ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রাজধানীসহ সারাদেশে ৬০টি করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও ভিড় সামাল দেয়া যাচ্ছে না। যত বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে তত বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অনেকেই নমুনা পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাচ্ছে না। সুযোগ পেলেও পরীক্ষার রিপোর্ট দেরিতে পাওয়া যাচ্ছে। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার আগে রোগীর মৃত্যুর সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ছেলেমেয়ে, ভাইবোন তাদের বাবা-মাকে করোনা আক্রান্ত হয়েছে বলে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে।

রোগতত্ত্ব ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশেরও বেশি রোগী সাধারণ জ্বরের চিকিৎসার মতোই চিকিৎসায় ভালো হয়ে যায়। কিন্তু শতকরা ১০ শতাংশ রোগীর হাই ফ্লো অক্সিজেনসহ আইসিইউতে চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে কয়েকটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সেগুলোতে সর্বসাকুল্যে আইসিইউ শয্যাসংখ্যা রয়েছে মাত্র ৩৯৯টি। এসব আইসিইউয়ের সব যন্ত্রপাতি সচল না থাকায় রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে কম। করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে আইসিইউ শয্যার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে, ‌মেনে নেয়া কষ্টকর হলেও এটাই এখন রূঢ় বাস্তবতা। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা উচ্চমহল থেকে তদবির করেও আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যারা ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে কাজ করছেন সে সকল স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের (চিকিৎসক-নার্স অন্যান্য স্টাফ) মধ্যে তিন সহস্রাধিক ইতোমধ্যেই করোনা আক্রান্ত এবং আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য সেক্টরের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের নড়বড়ে অবস্থা। বছরের পর বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে সরকারি হাসপাতালে বড় বড় দালানকোঠা নির্মাণ ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নামে নানা যন্ত্রপাতি কেনা হলেও মূলত মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানোর জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়নি। আর কেনা হয়ে থাকলেও সেগুলো মানসম্মত ছিল না কিংবা দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতার কারণে পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা প্রতিদিনের স্বাস্থ্য বুলেটিনে দেশের জনগণকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (মাস্ক পরিধান, নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ও স্যানিটাইজার কিংবা সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধৌত করা) মেনে চলতে পরামর্শ দিলেও তা অনেকেই পালন করছেন না। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার রাজধানীসহ সারাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন শুরু করেছে। পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর রাজাবাজারে এবং বেশ কয়েকটি জেলায় লকডাউন চলছে। গত ৫ এ‌প্রিল অনির্দিষ্টকালের লকডাউন ঘোষণা করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিরোনামে একটি মতামত কলামে লিখেছিলাম। দুই মাসেরও বেশি সময় পর এসে পরিস্থিতির অবনতি দেখে মনে হচ্ছে ওই সময় সারাদেশে লকডাউন করলে হয়তো বা আক্রান্ত বা মৃত্যু সংখ্যা কম হতো।

তবে বর্তমানে অবস্থার জন্য শুধু সরকারই দায়ী নয়, রাজধানীসহ সারাদেশের জনগণ দায়ী। গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে যখনই রাস্তাঘাটে বের হয়েছি তখনই দেখেছি অপ্রয়োজনে অনেক মানুষ ঘোরাফেরা করছে। কোথাও কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে দেশে করোনাভাইরাসের অস্তিত্বই নেই! কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই করোনাভাইরাস কিন্তু আইসিইউ বিশেষজ্ঞদের বাঁচতে দেয়নি। সুতরাং সাধু সাবধান, নিজের জীবন নিজেই বাঁচান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

লেখক: বিশেষ সংবাদদাতা ও প্রধান প্রতিবেদক, জাগোনিউজ২৪.কম।

এইচআর/বিএ