ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অক্ষমতার আর্তনাদ ও বুকচেরা হাহাকার

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম | প্রকাশিত: ০২:৫৯ পিএম, ১১ জুন ২০২০

মানুষের অবাধ্যতা, রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করার প্রবণতা, অবাধ ঘোরাঘুরি ও পায়ে পায়ে বয়ে চলা করোনার জীবাণু অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং কন্ট্যাক্ট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থাকলেও মানুষজন দিব্যি পিকনিক মুডে ঘুরছে, কীসের বালাই, কীসের নিষেধাজ্ঞা, কীসের করোনা? তাদের অবাধ ছোটাছুটি দেখলে মনে হয় দেশে কোনো করোনা নেই। এই বেহুদা ঘোরাফেরা করা মানুষগুলো আমার-আপনার মৃত্যুর কারণ হবে। আমার খুব ভয় হয় চার বছরের ছোট্ট সন্তানটিকে কোলে নিতে। কিন্তু সন্তানতো সারাদিন পথ চেয়ে বসে থাকে, কখন তার বাবা আসবে।

বাবাতো আসেন ফিরে, কিন্তু পথের হাজারো ধুলি, ময়লা আর সহস্র মানুষের ঠেলাঠেলি, ধাক্বাধাক্কি আর গিজগিজ করা ভিড় ঠেলে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষের মুখে থাকে না মাস্ক, আর থাকলেও তা থাকে থুতনিতে। বাতাসে বায়ুতে কতজনার আচমকা হাঁচি-কাশির স্নিজিং ওড়ে, কত জলকণা নাকে মুখে ঢোকে, আর এভাবেই বাসায় ফিরি। নিজে যতটা পারি সতর্ক থাকার চেষ্টা করি। মাস্ক, গ্লাভস পরিহিত থাকি। তবুও কী আর হয় রক্ষা?

পাঁচটি মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আমার সন্তান, মা-বাবা, স্ত্রী ও আর পরম স্নেহের ছোটবোন। তাদের জীবন নষ্ট করে দেয়ার কোনো অধিকার আমার নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে আমিই হব তাদের জীবনের আততায়ী। তারা গৃহে অবস্থান করছে এবং নিয়ম মেনে চলছে। কিন্তু আমাদের সব মানুষের জীবনতো জীবিকার কাছে জিম্মি। জীবিকার প্রয়োজনে এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, দেশের মানুষকে আর্থিক পরিষেবা দিতে কর্মস্থলে যাই। সেখানেও নিয়ম মেনে চলি। কিন্তু পরাজিত হয়ে যাই রাস্তার মানুষগুলোর কাছে।

সারাদিন এত কষ্ট করে এত সতর্ক থাকার পর যখন রাস্তায় বের হই, তখন সব শেষ করে দেয় আইন না মানা মানুষগুলো। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি তো আছেই। শুধুই আমাদের অসতর্কতা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমার পরিবারের মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখার দায়িত্ব আমার। কিন্তু আমার অক্ষমতার কান্না কে শোনে? তাদের প্রশ্ন করার, অভিযোগ দেয়ার অথবা কোনো আকুতি জানানোর ভাষা নেই বা তারা স্তব্ধ হয়ে গেছে আমাদের আইন না মানা মানুষগুলোর কাছে। এমন অক্ষমতার আর্তনাদ আমার মতো আরও কতজনার।

প্রতিদিন মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে ঘর থেকে বের হই আর সারাদিন জীবাণু সংক্রমিত এলাকা পায়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি, নিয়ন্ত্রণের কিংবা সুনিয়ন্ত্রিত থাকার আমার আর কোনো উপায় নেই। মানুষের অজ্ঞতা ও অবিমৃষ্যকারীতায় ধ্বংসের ময়দানে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে প্রাণসংহারে ধীরে ধীরে দেশের এ প্রান্তর থেকে ও প্রান্তর ছেয়ে গেছে। সমগ্র দেশের মানুষের ভেতর আজ কেমন যেন একটা নাভিশ্বাস।

মানুষকে সচেতন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কেউ বুঝেও বোঝে না। সবাই ভাবলেশহীন। ‘আর একটু সচেতন হও, একটু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলো রে ভাই’ এই কথা বলে। আমি কেন সারাদেশে জেলা প্রশাসন, মাঠ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম কারও চিল্লানো কি কেউ শুনছে? কারও কথা না শোনা- এটা কি খুব বাহাদুরী?

আজ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রতিদিন চোখের সামনে কত মানুষ, কত সন্তান, কত বাবা-মা মরে যাচ্ছে করোনায়, সামান্য সর্দি-কাশি জ্বরে চোখের সামনে ঝরে পড়ছে কত মানুষ। কল্পনা করুন তো, চোখের সামনে আপনার একমাত্র সন্তান ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে অথচ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকু সময়মতো নিতে পারছেন না। কেমন লাগবে? চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও সুশাসনের অভাব আজ জাতির বক্ষচিরে আর্তনাদ তৈরি করেছে।

আজ ইথারে শঙ্খধ্বনিতে পোড়ামাটির ঘুম ভেঙেছে, ক্লান্ত শ্রান্ত পুরুষের বুকপকেটে জমেছে ব্যর্থতা আর হতাশার থৈ থৈ জল। অক্ষমতা আমাদের খুবলে খুবলে খাচ্ছে। সীমিত আয় অথবা সীমিত সাপোর্টের দেশে আমার আপনার এর চেয়ে বেশি কিছুই করার নেই। দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার এলাকার এক চাচা যথেষ্ট টাকা-পয়সাও আছে তার, তিনি মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাধারণ বেডে। যার এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নেয়ার মতো সামর্থ্য আছে, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সমগ্র ঢাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটা আইসিইউ বেড ম্যানেজ করা যায়নি।

এমন অনেক বড়লোকই আছন যারা রাতারাতি একটা হাসপাতাল তৈরি করতে পারেন, একটা আইসিইউ ইউনিট যিনি বা যারা ইচ্ছা করলে নিজ বাড়িতেই করতে পারেন, তারাও আজ সাধারণ মানুষের কাতারে। তাদের চিকিৎসাও হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতোই। আজকের এই উদ্ভূত পরিস্থিতি পৃথিবীর মানুষকে এক করে ফেলেছে। পৃথিবীর মানুষকে আরও বেশি অক্ষম ও অসহায় করে ফেলেছে। একমাত্র স্রষ্টার কৃপাই পারে, আমাদের এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

এইচআর/বিএ/এমএস