ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না
২৬ মার্চ থেকে কেন সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছিল, সেটা আমরা সবাই জানি। অত্যন্ত ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস যাতে দ্রুত ছড়াতে না পারে। ৬৬ দিন পর ৩১ মে কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সবকিছু খুলে দেয়া হলো, তা কিন্তু আমরা জানি না। মাঝের ৬৬ দিনে কি তাহলে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে? চলুন একটু পরিসংখ্যান দেখে আসি। ৮ মার্চ প্রথম শনাক্তের পর দেশে ১ জুন পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৫৩৪ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ, আর ১ জুন পর্যন্ত মৃত্যু ৬৭২ জনের। এবার দেখি সাধারণ ছুটির অর্জন।
২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে- এই ৬৬ দিনে মারা গেছেন ৬৪৫ জন, আক্রান্ত ৪৭ হাজার ১০৯ জন। এই পর্যন্ত পড়ে কেউ ভাবতে পারেন, তাহলে তো সাধারণ ছুটি কোনো কাজের নয়। সাধারণ ছুটির সময়ই তো মৃত্যু ও সংক্রমণ বেশি হয়েছে। না ভাই অঙ্কটা এত সহজ নয়। সাধারণ ছুটি না থাকলে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হতে পারতো। আর আমরা যদি ঢিলেঢালা হরতালের মতো সাধারণ ছুটিকেও ঢিলেঢালাভাবে পালন না করে যদি কারফিউয়ের মতো করে পালন করতে পারতাম, তাহলে এই সংখ্যাটা আরও অনেক কম হতে পারতো।
বাস্তবতা হলো শারীরিক দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা ছাড়া করোনা সংক্রমণ রোধের আর কোনো উপায় এখনও আবিষ্কার হয়নি। তাই সাধারণ ছুটি বলেন, লকডাউন বলেন, ইমার্জেন্সি বলেন, কারফিউ বলেন; ঘরে থাকার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের এবং সরকারের- দুই পক্ষের খামখেয়ালিতে ৬৬ দিনের ঢিলেঢালা সাধারণ ছুটিতে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। সরকারও সাধারণ ছুটি কার্যকরে কঠোর হয়নি, আমরাও সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলেছি। আমরা আসলে বোঝার চেষ্টাই করিনি, আমাদের এই লুকোচুরিটা আসলে সরকার বা পুলিশের সাথে নয়; এটা আজরাইলের সাথে। আর আজরাইলের হাত থেকে অন্তত পালিয়ে বাঁচার উপায় নেই। কিন্তু পরিবারের কেউ বা অন্তত নিকটজনের কেউ আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কারও টনক নড়ে না।
কিন্তু খোলার দিনেই মৃত্যু এবং সংক্রমণের রেকর্ড দেখে সবাই আবার নড়েচড়ে বসেছে। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর নিয়মিতই সংক্রমণ এবং মৃত্যুর বাড়তি সংখ্যাই বহাল থাকছে। এই লেখা যখন লিখছি, তার আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন সর্বোচ্চ ৪২ জন। সব মিলিয়ে মারা গেছেন ৮৮৮ জন, আক্রান্ত ৬৫ হাজার ৭৬৯। আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ এখন শীর্ষ ২০এ ঢুকে পড়েছে। অনেকের ধারণা আক্রান্তের এই সংখ্যা আরও বেশি। বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও টেস্ট সুবিধার আওতার বাইরে। আর করোনার লক্ষণ নিয়ে মৃতদের যোগ করলে মৃতের সংখ্যাও কম নয়।
প্রতিদিন দুপুর আড়াইটায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিং যেন আতঙ্ক নিয়ে আসে। টিভির স্ক্রলে ক্রিকেট স্কোরের মতো মৃত্যুর আপডেট হয়। কী বেদনাদায়ক সময় পার করছি আমরা। তবে ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসা, সাধারণ ছুটি শেষেরে প্রভাব এখনও পড়েনি সংক্রমণ এবং মৃত্যুতে। তার আগেই এই মৃত্যুর মিছিল আমাদের শঙ্কিত করে। অনেকেই এখন বলাবলি করছেন, তবে কি খুলে দিয়ে ভুল হলো? ভুল হোক আর শুদ্ধ, একসময় না একসময় তো খুলে দিতেই হতো। করোনা কবে যাবে বা আদৌ যাবে কিনা, কেউ জানে না। সাধারণ ছুটি তো আর অনন্তকাল চলবে না।
তবে সাধারণ ছুটির সময়টা খুলে দেয়ার প্রস্তুতিতে কাজে লাগানো দরকার ছিল। মানুষকে কঠোরভাবে ঘরে আটকে রেখে সরকার ঠাণ্ডা মাথায় করোনা মোকাবিলার পরিকল্পনা করতে পারতো। প্রথম কথা হলো, কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউসহ পর্যাপ্ত হাসপাতাল তৈরি রাখা, যাতে একজন লোকও চিকিৎসা বঞ্চিত না হয়। কিন্তু এটা হয়নি। শুরুতে তো বটেই, বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরুর তৃতীয় মাসেও কোভিড বা নন কোভিড দুই ধরনের রোগীরই চিকিৎসা পেতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। হয়রানির আরেক বড় উৎস হলো, করোনা টেস্ট।
আড়াই মাস পর করোনা বাংলাদেশে এলেও সরকার প্রায় কোনো প্রস্তুতিই নেয়নি। ১৮ কোটি মানুষের দেশে মাত্র দুই হাজার টেস্টিং কিট নিয়ে আইইডিসিআর দিনের পর দিন পূর্ণ প্রস্তুতির যে গল্প শুনিয়েছে, তা রীতিমতো অপরাধ। এখন দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার টেস্ট হচ্ছে। তাও চাহিদার চেয়ে অনেক কম। এখনও প্রতিদিনই টেস্টের জন্য মানুষের হাহাকার। টেস্টের সিরিয়াল নাকি বিক্রি হয়। অনেকে অনেক লক্ষণ নিয়েও টেস্ট করার সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেকে ভয়ে টেস্ট করতে হাসপাতালে যেতে চাচ্ছেন না। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা টেস্ট করার জন্য ব্যাকুল। একটু জ্বর জ্বর লাগলেই তারা টেস্টের সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে যান। করোনা পজিটিভ হলেই তারা প্রণোদনা এবং ছুটি পাবেন।
আমি আগেই বলেছি, সাধারণ ছুটি বলুন আর লকডাউন; তা একসময় শেষ হবেই। কিন্তু সেই শেষের একটা প্রস্তুতি লাগে। হঠাৎ খুলে দেয়া যায় না। ধাপে ধাপে প্রায়োরিটি ঠিক করে খুলতে হয়। কিন্তু আমরা করলাম উল্টো কাজ। প্রথমেই খুলে দিলাম সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস। তারপর খুললাম শপিংমল এবং উপাসনালয়। অথচ স্বাভাবিক বিবেচনায় যেসব জায়গায় জনসমাগমের শঙ্কা, সেসব খুলতে হয় সবার শেষে। আবার কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ সাধারণ ছুটি নামের প্রহসনের ইতি ঘটলো। কিন্তু ছুটি শেষ হওয়ার পর আমরা এখন ব্যস্ত হয়ে গেলাম, কীভাবে সব চলবে, তা ঠিক করতে। বাসভাড়া কত হবে, লঞ্চে কীভাবে যাত্রী উঠবে, ট্রেন কীভাবে চলবে; এই বিষয়গুলো আগেই ঠিক করা উচিত ছিল।
সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর জানা গেল, সচিবালয়ে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি কাজ করবেন। অথচ এই সিদ্ধান্তটাও তো আগেই নেয়া উচিত ছিল। তাহলে মানুষের ভোগান্তি কম হতো। সবকিছু খুলে দেয়ার পর এখন সরকার করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় গোটা দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন জোনে ভাগ করার পরিকল্পনা করছে। ভাবা হচ্ছে, এক জোনের সাথে আরেক জোনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার। অথচ হুট করে সাধারণ ছুটি শেষ করার আগেই এই ভাগ করার কাজটি করা উচিত ছিল। সেই ভাগ অনুযায়ী ধাপে ধাপে খুলে দেয়া বা কড়াকড়ি আরোপ করা যেত।
এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, বেশি আক্রান্ত এলাকা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সরকার আরও কঠোর হবে। শুনে অবশ্য আমার হাসি পেয়েছে। কারণ সরকার তো কখনোই কঠোর ছিলই না। আরও কঠোর হবে মানে কী? ওবায়দুল কাদের যে হুমকি দিয়েছিলেন তা মানছে না কেউই।
দেশে চলছে ফ্রিস্টাইল স্বাস্থ্যবিধি। এখন শোনা যাচ্ছে, সরকার আবার লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংক্রমণের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে কঠোর সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অন্তত অঞ্চলভিত্তিক কঠোর লকডাউন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সবকিছু খুলে দিয়ে করোনাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে, এখন আবার লকডাউনে গেলে তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ঢিলেঢালা সাধারণে ছুটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষকে লকডাউন মানানো যাবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েই যায়।
পুরো পরিকল্পনাটাই করা দরকার ছিল, ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির সময়। তখন কিছু না করে, এখন আমরা বলছি কঠোর লকডাউনের কথা। দৈত্যকে একবার বোতল থেকে বের করে ফেললে তাকে আবার বোতলবন্দী করা সহজ নয়। করোনার দৈত্য আমরা বিমানবন্দরেই আটকাতে পারতাম। সেটা না করে সারাদেশে ছড়িয়ে এখন মোকাবিলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেই যাচ্ছি। যেটা অনেক কঠিন। তবুও করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাটা আমাদের চালিয়ে যেতেই হবে।
এইচআর/বিএ/জেআইএম