বিষয়টি আবার ভেবে দেখা দরকার
পক্ষকালের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে ‘সীমিত পরিসরে’ অফিস-আদালত, গণপরিবহন, শেয়ার মার্কেট, বাজারঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলে জানা গেছে। হঠাৎ করে সবকিছু খুলে দেয়ার এ সিদ্ধান্তে প্রায় তিন মাস অনভ্যস্ত জীবন-যাপন করা মানুষগুলো দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের কর্মকাণ্ড করছে। আর এই উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে করোনা ঝুঁকিও। বলা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর ফলে মানুষের জীবনের ক্ষতি আরো বিস্তৃত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেবে। অবশ্য দিন যত যাচ্ছে, আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা তত বাড়ার বিষয়টি আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, টেস্টের পরিমাণ যত বাড়বে, আক্রান্তের পরিমাণও তত বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যখন বলা হচ্ছে, তখন সব খুলে দেযার এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অশুভ ফল বয়ে আনতে কিনা সেটা গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উপর সবসময় ভরসা করা একজন মানুষ। যে কোনো সঙ্কটকালে তার সিদ্ধান্ত জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ প্রশংসা পেয়েছে। শেখ হাসিনার অসীম সাহসিকতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তারপরও সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের অধিকাংশ সচেতন মানুষের মাঝে ভীতির সঞ্চার করেছে। সে কারণে সরকার তথা বাংলাদেশের বাতিঘর ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ শেখ হাসিনা সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করবেন কিনা ভেবে দেখতে পারেন। নতুবা ভয়াবহ কোনো সঙ্কট আমাদেরকে গ্রাস করতে পারে।
সরকার ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন নীতি নির্ধারকদের অনেকেই বলছেন, করোনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, হার্ড ইমিউনিটি গ্রো করার কথা। প্রথমটি অর্থাৎ ‘খাপ খাইয়ে চলা’র চেষ্টা করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের যে গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এখনই খাপ খাইয়ে চলার সময় এসেছে বলে মনে হয় না। তেমনটি করার আগে দেশের সব মানুষকে টেস্টের আওতায় আনতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে কোভিড এবং নন-কোভিড পেশেন্ট। আর ইমিউন সিস্টেম গ্রো করার মতো সময়তো সুদূর পরাহত। যতদিন পর্যন্ত মানুষ টিকার আওতায় না আসবে ততদিন পর্যন্ত হার্ড ইমিউনিটি খুব একটা কাজ করবে না। তাছাড়া জীবনপদ্ধতির উপর নির্ভর করা ইউমিউন সিস্টেম ইচ্ছা করলেই অতি মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হয় না সবার জন্য।
এমনিতেই দেশের মানুষ করোনাকালে দায়িত্বশীল আচরণ করেনি। সরকার ও গণমাধ্যমের প্রচারণার সূত্র ধরে মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়লেও বাড়েনি সহনশীলতা। করোনার কারণে সরকার ঘোষিত প্রায় দুই মাসের (২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত) সাধারণ ছুটিকালে মানুষের আচরণ ও চলাফেরা ছিল যথেষ্ট রকমের ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময়কালে কার্যকর লকডাউন যেমন নিশ্চিত করা যায়নি, উল্টো কিছু কিছু সিদ্ধান্ত বিপজ্জনকভাবে করোনা সংক্রমণ বাড়িয়েছে। যেমন এপ্রিলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিনা কারণে রাজধানীতে নিয়ে আসা ও ফিরে যেতে বাধ্য করা, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার একটি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে জানাযা উপলক্ষে লাখো মানুষের সমাগম হতে দেয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইতালী থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, গেলো ঈদ-উল-ফিতরের আগে দোকানপাট খোলার অনুমতি দেয়া, মানুষকে শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে দেয়া, আবার গ্রাম থেকে শহরে আসায় কোনো বাধা না দেয়া ইত্যাদি কারণে সংক্রমণ ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে গেছে।
ঘোষিত লকডাউন চলাকালে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কাঙ্খিত মাত্রায়। অনেকক্ষেত্রে কঠোরতা প্রদর্শন করা হলেও উল্লেখযোগ্য ফল আসেনি। ফলে বেড়েছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যাও। মূলতঃ লকডাউন বা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’র মতো। আর এখন সবকিছু খুলে দেয়ার পরে পরিস্থিতি আরো নাজুক হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে। সরকার পক্ষ থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ খোলা রাখার ঘোষণা দেয়া হলেও দেশের কোথাও তা আর সীমিত নেই। মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সড়কের পাশের দোকানপাট এমনকি রাস্তায় থাকা চা-দোকানগুলোও খোলা হয়েছে। এসব স্থানে মানুষ গাদাগাদি করে আসা-যাওয়া ও অবস্থান করছে। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমশই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এটা সত্যি যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অনেক অর্জন সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্যখাত কিছুটা গতিশীল হয়েছে। কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গেছে। নেই পর্যাপ্ত হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র। হাসপাতালে বেডের সংখ্যাও অপ্রতুল, পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। সর্বোপরি যে কোনো উদ্বেগজনক বা নতুন পরিস্থিতিতে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলি। এটা আমাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। আর এসব কারণ আমাদের মাঝে ভীতি বাড়িয়ে দেয়।
এরকম পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ বোদ্ধামহল কঠোর লকডাউনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, দেশে সংক্রমণের হার শুধু ঊর্ধ্বমুখীই নয়, সর্বোচ্চসীমায় কখন পৌঁছাবে সেটিও অনিশ্চিত। সে কারণে এখন কার্যকর বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দেশের সব অঞ্চলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেহেতু সব অঞ্চলেই কার্যকর লকডাউন ও টেস্টের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেজন্য আমাদেরকে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। টেস্ট ছড়িয়ে দিতে হবে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়। কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সব ধরনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে টেস্টের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
আইইডিসিআরকে আরো স্বাধীনতা দেয়া দরকার। স্বাস্থ্য খাতকে আমলাতন্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে বের করে এনে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ দলকে স্টিয়ারিংয়ে রাখা দরকার। রোগতত্ত্ববিদ, চিকিৎসক. জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সঙ্কটকালীন অর্থনীতি সুরক্ষা বিষয়ক গবেষকদের আরো সক্রিয় করা দরকার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কোভিড, নন কোভিড একই চিকিৎসাগারে চিকিৎসার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন বহুবার। সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।
একসময় লকডাউন আমাদেরকে তুলতে হবে। কিন্তু তার আগে আক্রান্ত ও অনাক্রান্তদের চিহ্নিত করা দরকার। সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রেণে রাখার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে স্বাস্থ্যসুবিধা। যেটি একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা করেছেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে। তার মস্তিষ্কপ্রসূত সেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকেও এখন টেস্টের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনের চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক মন্দা বড় নয়। করোনার মাধ্যম ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যত কম রাখা যায় এবং করোনাকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জয়ী হবেন সেই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ