এই খুনিদের তৈরি করেছে কারা?
আশির দশকের কথা বলছি। আমি তখন খুবই ছোট। এক পরিচিত প্রকৌশলীর বিয়ের ঘটকালির সুবাদে আমার বাবা-মা কেমন করে যেন জড়িয়ে গেল সেই বিয়ের কেনা কাটা ও অন্যান্য আয়োজনে। সেই অনেক শিশুকালেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিয়ের বাজারের বহর দেখে। পাত্রের ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। গ্রামের অবস্থা ভালো নয়। অথচ বিয়ের বাজারের নাকি কোনো বাজেট নেই।
বড়দের টুকরো টুকরো কথা থেকে যতটা বুঝতাম, মনে হতো রূপকথার গল্প। চাইলেই গাড়ি চলে আসছে, চাইলেই টাকা, চাইলেই জনবল। পাত্রের বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা ছাড়া ‘হও’ বলামাত্র ঠিকাদাররা বিয়ের রাজকীয় আয়োজন করে ফেলল। আজ পর্যন্ত সে রকম বিয়ে আমি খাইনি। খাঁটি ঘিয়ে মুরগি দিয়ে চাল নয় বরং চাল দিয়ে মুরগি রান্না হয়েছিল। এই পাত্রটি আর কেউ নয়, আমাদের প্রিয় বুয়েট থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী যিনি দুহাতে ঘুষ খাওয়া শুরু করেছিলেন চাকরি শুরুর সাথে সাথে এবং এই ভদ্রলোক কিন্তু ব্যতিক্রম না, বলা যায় এটাই স্বাভাবিক।
আমার বাবার চাকরির সুবাদে প্রচুর প্রকৌশলীর সাথে উনাকে কাজ করতে হতো। নিজের চোখে দেখেছি যে এই অসংখ্য দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর মানুষের মাঝে কাউকে শুধু সৎ হয়ে টিকে থাকতে হলে কত ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল প্রকৌশলী মানেই ঘুষখোর। সে সময় দেশে প্রাইভেট সেক্টর ততটা ছিল না। যে কারণে বেশিরভাগ প্রকৌশলী ছিল সরকারি চাকরিতে। খুব দৃঢ় চরিত্রের মানুষ না হলে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে যেভাবেই হোক আপনাকে অন্যায়ের সাথে জড়ানো হবে। তখন সরকারি চাকরির বেতনও ছিল অনেক কম। একমাত্র বাসা আর গাড়ি ছাড়া আর কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল বলে মনে পড়ে না। এত মেধাবী যে মানুষগুলো, তাদের মেধার মূল্যায়ন হবে না, ঠিকমতো, অন্যদিকে এই পাহাড় পরিমাণ সম্পদের প্রলোভন। তার ওপর নেই কোনো আইন-কানুনের বালাই। ঘুষ খাওয়ায়ই তো সবচেয়ে সহজ পন্থা।
এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে গত বিশ ত্রিশ বছরে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ও অনেক অনেক বেড়েছে। আগে মানুষ ঘুষ খেত রেখে ঢেকে। আইনের ভয়ে যতটা না, তার চেয়ে বেশি ছিল সমাজ, ধর্ম এসবের ভয়। এখন কেউ এগুলো পরোয়া করে না, কারণ প্রায় সবাই ঘুষ খায়। আমি আমার নিজের বুয়েটিয়ান পরিচিতদের খোলাখুলি বলতে শুনেছি ‘হ্যাঁ, আমি ঘুষ খাই’। যে যত বেশি খায় তার তত বেশি গর্ব, কারণ সে তত বেশি বড়লোক। খালি একটু জায়গামতো ক্ষমতাবান মানুষদের হাতে রাখলেই হয়, একমাত্র সেখানেই দেখেছি তাদের তেলমর্দন করতে, মিউ মিউ করতে। এসব দেখলে বা শুনলে নিজেকে বুয়েটিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে।
একটা রাষ্ট্র বা সমাজে যেখানে নয়শ নিরানব্বই জনই এমন, আর একজন দেলোয়ার, সেই দেলোয়ার তো পথের কাঁটা। সেই দেলোয়ার ঠিকাদারদের পথের কাঁটা, ঠিকাদারদের বখরা পায় যারা তাদের পথের কাঁটা আর তার সহকর্মী নয়শ নিরানব্বই জন প্রকৌশলীরও পথের কাঁটা। আজ যদি এক হাজার জনে অন্তত একশজন দেলোয়ারও থাকত, তাহলে কিন্তু এই খুনি সম্প্রদায় তৈরি হতো না। আর এই সৎ, সাহসী মানুষটিকে প্রাণ দিতে হতো না। যে কারণে আশি, নব্বই দশকে ঘুষখোর প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও, সে সময় সৎ অফিসাররা খুন হতো না। অনেক ঝামেলা পোহাত হয়তো, কিন্তু প্রাণের ভয় তো ছিল না। কারণ তারা সংখ্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বিরল প্রজাতির মানুষ ছিল না।
এই একটি খুন কী করল? এখন দেশের আনাচে-কানাচে যতজন সৎ প্রকৌশলী বা অফিসার আছেন, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিল। এখন তারা দশবার ভাববে প্রাণ বাঁচাব নাকি নীতি? তাদের স্ত্রী, মা, সন্তানরা বলবে ‘থাক না, চোখবুজে থাক, তুমি নিজে তো আর ঘুষ খাচ্ছ না, চুপ করে থাক, আমাদের কাছে তোমার জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি। দেলোয়ারের মতো তোমাকে মেরে ফেললে আমাদের কী হবে?’
খুব দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার না হলে, খুনি এবং তার পেছনের নির্দেশকারীদের সাজা না হলে আমাদের দেশে আর একটি দেলোয়ারও থাকবে না।
লেখক : প্রবাসী কলামিস্ট, লেখক।
এইচআর/বিএ