মা দিবস এবং বাস্তবতা
সন্তান হিসেবে মা দিবসে কিছু লেখার দায়বোধ করছি। লেখক হিসেবে এটা দায়িত্বও। মা দিবসে কেবল মাকে নিয়েই লিখব তা কী করে হয়? এদেশে হতভাগা বাবাদের গল্পও যে অনেক আছে। বাবা-মায়ের জীবনের গল্পতো সেই একই রকম। এমন কিছু ঘটনায় চোখে জল আসতে চায়; হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এ জাতীয় ঘটনার সাথে আমরা মোটেও নতুনভাবে পরিচিত নই।
কী সেই ঘটনা? অতীত নিকটে পত্রিকায় প্রকাশিত এমন সংবাদের একটি- ‘করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধা মাকে রাস্তার পাশে ফেলে গেছে সন্তান ও স্বজনরা’। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদটি আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মার সম্পর্ক বিষয়ক এতদিনকার ধ্যান-ধারণার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এ সংবাদ আমাদের সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে উন্মোচন করে।
আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সাথে বেশ পরিচিত আমরা। এক দশক আগেও অধিকাংশ বাঙালির মাঝে বৃদ্ধাশ্রমের তেমন ধারণা ছিল না। এখন দেশের অনেক জায়গায়ই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আর নরকনামীয় এ বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছে আমাদের পরমশ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ পিতা-মাতার। সেখানে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়। অনেকে আবার জন্মদাতা পিতা-মাতার জন্য অতটুকুও ভদ্রতাও দেখান না। ওরা জন্মদাত্রিকে ফেলে আসেন রাস্তাঘাটে, নর্দমায়। ওইসব পশু শ্রদ্ধেয় মুরুব্বিদের কখনোবা ডাস্টবিনে ফেলে আসতেও দ্বিধা করেন না।
এমন ঘটনা কতটা অমানবিক, কতটা বিবেকবর্জিত এবং আপত্তিকর? মা-বাবার জন্য অপমানজনকতো বটেই! এইসব অমানবিক বিষয়কে আমাদের সামনে আনা উচিত। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের অপরাপর স্বজনদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়। এ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন হতে পারে। পরিবারের লোকজন এ আন্দোলনে সামিল হবেন, প্রতিবেশীরা যোগ দেবেন। রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট্র এমন অমানবিক বিষয়টিকে আইনের আওতায় আনতে পারে। নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে এমন কু-সন্তান কিংবা কু-পুত্রবধূদের তাৎক্ষণিক সাজার বিধান করতে পারে। এমন কিছু সাজার নজিরও ইতোমধ্যে দেখেছি আমরা। বিষয়গুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য আছে।
পরিবারের অন্য সদস্য, প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার কর্মস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সরকারি কিংবা বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানেই ওই কু-সন্তান কর্মরত রয়েছে তার ঊর্ধ্বতনরা বিষয়টি দ্রুত আমলে এনে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে পারে। এ বিষয়টিতে ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকার পাশে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাব কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। পশুতুল্য ব্যক্তিটি ব্যবসায়ী কিংবা অন্য শ্রেণিপেশার হলে সামাজিকভাবে তাকে প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
মোদ্দাকথা হলো সকলকে সকলের জায়গা থেকে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা নিজেদের থেকে ভালো হয়ে গেলে। আমাদের সকলকে ভাবনায় আনতে হবে আমরা আমাদের পিতা-মাতার কারণেই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তারাই আমাদের আলোর মুখ দেখিয়েছেন। তারাই আমাদের আগুন-পানি, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, দিনদিন বড় করে তুলেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষেই হয়েছি। পিতা-মাতার কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। চরম অসহায় সময় তারা যখন পার করছেন তখন তাদের পাশে আমরা আর নেই। এমন অমানবিকতার পথটি সকল প্রকার নাগরিকের পরিহার না করা চরম মানবতার পরিপন্থী। এক কথায় বাবা-মার প্রতি এমন আচরণ করা চরম অন্যায়, দেশের এ জাতিয় আইন না থাকলেও তা চরম মানবিক অপরাধ বটে!
জানি আমাদের দেশে অনেক বৃদ্ধ মা-বাবার এমন পরিণতির সাথে এখন বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তারা সন্তান কিংবা পুত্রবধূর নিষ্ঠুর আচরণকে তাদের ললাটের লিখন হিসেবেই দেখেন। এদের কেউ কেউ নিজ সন্তানের অবজ্ঞা, অবহেলাকে সম্বল করে, পুত্রবধূদের রূঢ় আচরণকে অবলম্বন করে সকল অপমান নির্যাতন সয়ে নিজগৃহে পড়ে থাকেন। এছাড়া তাদের সামনে আর কীই বা করার আছে? কিছু করার কোনো পথ খোলাও থাকে না। আবার অনেকের নিজগৃহে সন্তান, নাতি-নাতনি আর পুত্রবধূর সাথে একসাথে থাকার সে ভাগ্যও হয় না।
হাল জামানায় সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অধিকার বিষয়ে সচেতনতা খুবই দরকার। মাতা-পিতা আর সন্তানের সম্পর্কে ঘাটতি হলেই পরিবারের শান্তি আনয়ন মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে এ কথাও সত্য পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও পিতা-মাতা-সন্তান সম্পর্কে কোথাও কোথাও ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। সে কারণে দেশে এখন দিনদিনই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। সে সংখ্যা যে অদূর নিকটে আরও ফুলেফেপে মস্ত হবে না তাই এখন ভবিতব্য। কিন্তু তা হতে দেয়া ঠিক হবে না। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতেই হবে। এ জন্য আমাদের, তাদের, আপনাদের, আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হওয়ার অবকাশও বিলক্ষণ আছে।
পিতা-মাতার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা সন্তানের কর্তব্য। জানি কথাটি ওইসব কু-সন্তানদের জন্য কিঞ্চিৎ গোলমেলে। সত্য কথা হলো তাদের মতে পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিয়েছেন তাই তাদের যথাযথ লালনপালন করবে এটা তাদের দায়িত্ব। আর তারাও তাদের সন্তানদের লালন পালন করবে এটা তাদের দায়িত্ব। এটা ওদের, আর ওটা তাদের দায়িত্ব। বাহ্ বেশ সাচ্চা যুক্তি বটে! মায়ামমতায় ঘেরা সোনার বাংলায় আমরা এমন সময় পার করছি এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তাদের এমন প্রতিক্রিয়া আর প্রস্তাবে কী হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তাদের যে জয়জয়কার অবস্থা হবে না তা কিন্তু বলা মুশকিল। দিনকে দিন তাদের দল ভারী হচ্ছে। আর তা করতে এ ব্যাপারে তারা মরিয়া হবে না, এমন ভাবনা সম্ভবত বাস্তবরহিত। আমাদের ততদিন ধৈর্য ধরতে হবে। তাতে আমাদের এইসব কু-সন্তানদের সামনে ধেয়ে চলার গতি লক্ষ করা যাবে বৈকি!
আরেকটি জীবনের গল্প দিয়ে লেখা শেষ করব। “বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি” ফেসবুকে সেদিন এ শিরোনাম একটি লেখার মন্তব্য আমি এভাবে লিখেছিলাম- “এই ছেলে তোকে কী বলে ডাকি বলতো? কুকুর, বিড়াল, শুকর? না এ নামে তোকে ডাকলে পশুজাতির যে আর মান ইজ্জত রইবে না। ডাকাডাকি বাদ দিই। বরং তোর মায়ের মতোই তোর জন্য দোয়া করি- তুই বেঁচে থাক বছরের পর বছর অনন্তকাল। খোদার কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন তোর অমানুষী মনে উপলব্ধি সৃষ্টি না করে তোর কাছে আজরাইল না পাঠান। চিঠি পড়ে তোর মায়ের কষ্ট আমি পুরোটা উপলব্ধি করতে পারছি না। এত বেশি কষ্ট উপলব্ধি করি কী করে? তোর জন্য ফরিয়াদ করি, খোদা যেন তোকে তোর মায়ের মতো সমকষ্ট দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করান। এর বেশি কষ্ট তোর জন্য বোধকরি প্রয়োজন পড়বে না। তোর মা কষ্ট যেমনটা পেয়েছেন ঠিক তেমন কষ্টই তোকে দিক খোদা। ভালো থাকিস..”।
ফেসবুকে আমার এ মন্তব্যের পর এর সমর্থনে শতাধিক মন্তব্য পেয়েছি যা পড়লে অনেকেরই চোখে জল আসবে। সদ্য বৃদ্ধাশ্রম পাঠানো ওই মা তার ছেলেকে লিখেছেন, ”খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোট দাদুভাই সবাই ভালো আছে তো? জানি তোদের তিনজনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ওহ বুঝতে পেরেছি! এখনও আমার ওপর থেকে অভিমান যায়নি বুঝি! আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রম পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কীইবা আমি করব বল, সময়মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। বাবা, কারণ আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিল না। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা! আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যা তড়িঘড়ি শুরু করে দিল তা দেখবার জন্য পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগল। এতে বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে! আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি! আর কেনই-বা ভালো থাকব না বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনও-কোনোদিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ বছর বেঁচে থাক।”
“আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।” কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রম। সন্তানের কাছে যাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা এতটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুনতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রম। শেষ বয়সে মস্ত ফ্ল্যাটের ঘরের কোণেও জনমদুখী মা-বাবার এতটুকুও জায়গা মেলে না। ওদের ছুঁড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানাবাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়িছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন একেবারে চুপ। তবে এ নিষ্ঠুরতা তাদের কেবলই কাঁদায়, এ কেমন নিয়তি?
একদিন যে সন্তানের জন্য বাবা-মা ছিলেন স্নেহময়, যে সন্তান একটু আঘাত পেলেই বাবা হয়ে উঠতেন চিন্তিত। যে সন্তানকে নিজে হাত দিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এবং কখনই নিজের অসুবিধার কথা সন্তানদের বুঝতে দেননি। আজকাল সমাজে এমন কিছু সন্তান দেখা যায়, যারা কিনা মা-বাবার এতসব আদর-যত্নের কথা ভুলে মা-বাবাকে ঠেলে দেয় অজানা গন্তব্যে। বৃদ্ধ ও অসহায় বলে তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। ঘরের মধ্যে সবার থাকার জায়গা হলেও এখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জায়গা হয় না।
আসলে একজন মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারাজীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে এসে তারা চায় একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যত্ন পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনও কোনো বাবা-মার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ