আই ডোন্ট নো!
আশরাফুল আলম খোকন
দুই গ্রামের মধ্যে চরম বিবাদ। কলহ লেগেই থাকে। দুটি গ্রামে শিক্ষিতের হার নেই বললেই চলে। দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে সবকিছুতেই চরম প্রতিযোগিতাও থাকে। দুই গ্রামের মোড়লরাই সিদ্ধান্ত নিলো তাদের গ্রামে পন্ডিত আনবে এলাকার লোকজনকে শিক্ষিত করার জন্য। যথারীতি দুই গ্রামেই দুজন পন্ডিত মশাই এলেন।
গ্রামের মানুষগুলোর কলহ ভাইরাস দুই পন্ডিতের মধ্যেও প্রবাহিত হলো। একজন আরেকজনকে সহ্যই করতে পারেন না। কে কত শিক্ষিত, কে কত অজ্ঞ- এসব জাহির করতেই দুই পন্ডিতের সময় চলে যায়। গ্রামের মানুষগুলোও তাদের নিজ নিজ গ্রামের পন্ডিতের পক্ষ নিয়ে নতুন করে কলহ শুরু করেছে।
এই কলহ নিরসনে দুই গ্রামের মোড়লরা সিদ্ধান্ত নিল দুই পন্ডিত একজন আরেকজনের পরীক্ষা নেবেন। যে পন্ডিত জয়ী হবেন, সেই গ্রামের পন্ডিত বেশি শিক্ষিত বলে গণ্য হবে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী একদিন এক বড় মাঠে দুই পন্ডিতের পান্ডিত্যের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। তাদের পক্ষ নিয়ে দুই গ্রামের শত শত মানুষ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে হাজির হলো। তুমুল উত্তেজনা সবার মধ্যে।
এই গল্পটা ছোটবেলায় পড়া, গল্পের নাম লেখকের নাম সবই ভুলে গেছি। গল্পটা অনেকটা এই রকমই ছিল যে, প্রশ্নটা অবশ্যই হতে হবে ইংরেজিতে। একজন পন্ডিত প্রথমে প্রশ্ন করেন সাথে সাথেই আরেকজন উচ্চস্বরে সঠিক উত্তর দিয়ে দিলেন। সাথে সাথেই আনন্দে মেতে উঠলো তার পক্ষের গ্রামের লোকজন। এবার বাকিজনের প্রশ্ন করার পালা। তিনিও উচ্চস্বরে প্রশ্ন করলেন সঠিক উত্তরও আসলো উচ্চস্বরে। কিন্তু বিধিবাম! সঠিক উত্তরের পরও পন্ডিতকে মারধর শুরু করলো তার গ্রামের লোকজন। গায়ে চুনকালি মেখে পন্ডিত মশাইকে বিদায় করে দিলো। অন্য গ্রামের লোকজন ঢোল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরে গেল।
দুই পন্ডিতের কেউ কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। এখন আসা যাক প্রশ্নটি কী ছিল। সঠিক উত্তর দেয়ার পরও কেন পন্ডিতকে চুনকালি মেখে বিদায় করা হলো। প্রশ্নটি ছিল ‘I don’t know’ এর বাংলা অর্থ কী। উচ্চস্বরে উত্তর এলো ‘আমি জানি না’। এরপর বাকিটা ইতিহাস।
এই গল্পটা বলার কারণ হচ্ছে যে, এই দেশের মানুষকে অনেকেই এর অর্থ না বোঝা জাতি মনে করেন। সাময়িক সফলতাও পায়। মেডিকেল সায়েন্স আমি বুঝি না। এই ক্ষেত্রে আমি ‘I don’t know’ পর্যায়ের একজন। এই জটিলতা ওই সেক্টরের লোকজনই ভালো বুঝবেন। তবে আমি এইটুকু বুঝি, যে কোনো কিছুই আবিষ্কারের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বাজারজাতকরণ করতে হয়।
করোনা কিটের ওপর গুগুল সার্চ এবং বিভিন্ন লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি তা হলো, এই কিটটির কার্যকারিতা কীভাবে পরীক্ষা করা যায় সেটি নিয়ে প্রথমে একটি প্রটোকল লিখতে হয় এবং সেই প্রটোকলটি অ্যাপ্রুভড হলে কিটটির কার্যকারিতা নিয়ে একটি এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণা হয়। গবেষণার সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের (ডিজিডিএ) কাছে জমা দিতে হয় এবং সম্ভব হলে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে পাবলিশ করা। ডিজিডিএ সকল তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে আপনাকে অনুমতি দেবে সেই কিটটি উৎপাদন এবং বাজারজাত করার। আপনি যদি এসব নিয়ে রাজনীতি করতে চান তাহলে এ নিয়ে জানাশোনার দরকার নেই। ‘I don’t know’ মার্কাদের মতো হয়ে হট্টগোল শুরু করবেন। বলবেন, রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্ট্রি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হচ্ছে।
আসলে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথমেই খটকা লেগেছিলো। শুরু থেকেই সরকার ওনার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এরপর থেকেই ওনার অভিযোগের আর শেষ নেই। আজকে বিদ্যুৎ দেয় না, কাল এই সমস্যা- এইসব বলে বলে মিডিয়াতে আসতে লাগলেন। বহুমত বহুপথের ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে সমস্যা থাকবেই। সমাধানের পথে যেতে হয়, ঘন ঘন মিডিয়াতে এলেই উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোনো নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে চান না তিনি। করোনা কিটের পরিবর্তে রাজনৈতিক কীটতত্ব নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।
এখন পর্যন্ত কোথাও এই ধরনের র্যাপিড টেস্ট কিট কার্যকর হয়নি। অনেক চাইনিজ কোম্পানি বানিয়েছিল এবং সেগুলো কিনে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডসের মতো দেশ ধরা খেয়েছে। একটি অযৌক্তিক কথা তারা বলেছেন যে, তারা নাকি বিদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্ত পরীক্ষা করেছেন। এই আজগুবি গল্প ‘I don’t know’র অর্থ না জানা মার্কা লোকজনের জন্য খুবই প্রযোজ্য। বিদেশে কোন দেশ তাদের অনুমতি দিয়েছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর রক্ত পরীক্ষার জন্য, তা কেউ জানলো না, শুধু তারাই জানলেন। করোনা রোগীদের জন্য যখনই কোনো কিছু আবিষ্কার বা প্রয়োগ হচ্ছে তা তো বিশ্ব মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। অথচ ওনাদের সফল প্রয়োগ শুধু ওনারাই জানলেন আর কেউ কিছু জানলো না। এটা গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই না।
ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো লোকজনের নিয়ম-নীতি না মানা নতুন কিছু নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করতেন না। কোনো মিটিংয়ে যেতেন না, বয়সও ৬৫’র বেশি, তাও জোর করে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পথ আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। যুক্তি ছিলো যেহেতু রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী ৬৫ বছরের বেশি বয়সেও হওয়া যায়। শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য ব্যাংকের এমডি পদে থাকার বয়স বাড়াতে হবে। তাদের সব আজগুবি আবদার।
অপপ্রচার শুনে আমার অনেক বন্ধু আমাকে বলেছেন যে সরকার নাকি বিদেশ থেকে করোনা শনাক্তকরণ কিট কিনবে। যেখানে নাকি অনেক ঘুষের লেনদেন হবে। এই রকম একটি আভাস আজ ডা. জাফরুল্লাহও প্রেস কনফারেন্সে দিয়েছেন। আমি তাদের এইটুকু নিশ্চিত করেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন ছাড়া সরকার কারও কাছ থেকেই কিছু নেবে না।
লেখক
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেসসচিব
এইচএ/জেআইএম