আমাদের স্বভাবশুদ্ধির এই চর্চা দীর্ঘস্থায়ী হোক
বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সংখ্যা। করোনার ভয়াবহতা নিয়ে এখন আর নতুন করে কিছু বলার নেই। বিগত এক মাসের অধিক সময় ধরে আমাদের দেশে আক্রান্ত, অসুস্থতা এবং মৃত্যুর খবরের মাধ্যমে আমরা ইতোমধ্যে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি বৈশ্বিক পরিমণ্ডল থেকেও। সে অভিজ্ঞতা নির্মম। ফলে সকলেই এ বিষয়ে এখন কমবেশি জানেন; শুধু জানেন বললে ভুল বলা হবে বরং করোনার ভয়াবহতা নিয়ে সাধারণ থেকে শুরু করে বিত্তবানদের সকলেই মোটামুটি ভালোই জানেন একথা বলা যায়। ফলে সর্বমহলে একপ্রকার আশঙ্কা ও আতঙ্ক দানা বেঁধে উঠেছে- উপরন্তু দিন দিন তা তীব্র থেকে হচ্ছে তীব্রতর।
তবু আশা করা যায় যে, ভাইরাসঘটিত এই ভয়ংকর রোগে অনেকের মৃত্যু ঘটলেও দেশ-বিদেশের সর্বত্রই বেঁচেও থাকবেন বহুসংখ্যক মানুষ। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে করোনা বা কোভিড-১৯ আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত এ রকম নানা প্রকারের দুর্যোগ ও মহামারি বিভিন্ন সময় মানবসভ্যতাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেসব মোকাবিলা করে মানুষ বেঁচেছিল- বেঁচে আছে। সেই ভরসাতে বিশ্বাস করি করোনাদুর্যোগের পরও বিশ্বের সর্বত্র বহুসংখ্যক মানুষ বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশেও বেঁচে থাকবেন অনেকেই। বেঁচে থাকা মানুষেরা এই পৃথিবীর আলো-বাতাস উপভোগ করবেন।
দুর্ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কবলে পড়ে যারা ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের জন্য সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। শুধু প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি পরপারে তাদের জীবন শান্তিময় হোক। করোনাঝড় একবার না একবার থামবেই। এই ঝড় থেমে যাবার পর এক নতুন পৃথিবীর নতুন নাগরিকে পরিণত হবেন বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান মানুষেরা। আমরা এখন ভাবীকালের বেঁচে থাকা সেইসব ভাগ্যবানদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করব যারা এই ভয়ংকর দুর্যোগ মোকাবিলা করে জীবনের জয়গানে পুনরায় মুখর হবেন।
করোনাতাণ্ডবের পর বেঁচে থাকা সেইসব ভাগ্যবানরা করোনা-জ্ঞানে নতুন অভিজ্ঞতায় জারিত থাকবেন। ভীষণ ভয়ংকর অবস্থা কাটিয়ে তারা পুনরায় জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হবেন। আস্তে আস্তে আবার শুরু হবে যাপিতজীবনের নানা ঘটনা পরম্পরার ধারাবাহিকতা। নতুন বিশ্বনাগরিকরা শুরু হওয়া তাদের নতুন জীবনটিকে আবারও কি পুরোনো ধারায় চালিত করবেন কি না সেই প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়। আবারও কি আমরা পুরোনো জীবনাচারের পথেই হাঁটব না কি করোনা আতঙ্কে পরিচ্ছন্নতার যে অভ্যাসগুলো এতদিন গৃহবন্দি তথা কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় রপ্ত করেছি তার সবই বেমালুম ভুলে যাব? নাকি আগামীতে আরও কোনো মহামারিরূপ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য এই অভ্যাসগুলো আমরা আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীর ও নিবিড়ভাবে অঙ্গীভূত রাখব?
আতঙ্কিত অবস্থায় নিজে পরিচ্ছন্ন থাকবার যেসব প্রচেষ্টা আমরা গ্রহণ করেছিলাম এবং আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখবার যে উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছিলাম তার সবই কি জলাঞ্জলি দিয়ে পুনরায় স্বভাবসুলভ গয়রহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ব? নিজেদের চারপাশের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে সুরক্ষা করতে পারি, এই বিশ্বকেও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রাখায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারি। বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ আমরা জীবনযাপনের একপ্রকার শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছি। পরিস্থিতিদৃৃষ্টে বুঝা যাচ্ছে যে, আগামী আরও দুই-তিন সপ্তাহ তার চর্চা করে যেতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটা চলবে না। গৃহবাসের দীর্ঘ এ সময়ে পরিচ্ছন্নতা সংশ্লিষ্ট আমাদের এই যে শিক্ষা অর্জিত হলো তা যেন আমরা একেবারে ভুলে না যাই সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই শিক্ষা করোনা-উত্তর বেঁচে থাকা ভাগ্যবান নাগরিকদের আজীবন চর্চার মধ্যে রাখতে হবে।
করোনা আমাদের আতঙ্কিত করেছে। সেই আতঙ্কে আমরা আমাদের জীবনচর্চায় বিগত কয়েক দিনেই ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা মোটামুটি একটি পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের দিকে নিজেদের পরিচালিত করতে সচেষ্ট হয়েছি। এই চেষ্টার ফলে আমরা আমাদের দীর্ঘদিনের দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিক কু-অভ্যাস ও কু-আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আমাদের এই পরিবর্তিত অভ্যাস ও আচরণসমূহ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনও পরিবেশ সুস্থ রাখার জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে বিশ্বাস এ জন্য গভীর যে, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য ইতোমধ্যে অনেক অভ্যাসের পরিবর্তনকে মেনে নিয়েছি। শুধু তাই নয় নিয়মিতভাবে সেসব পালনও করছি।
একসময় বাংলাদেশের মানুষ টিকা দিতে ভয় পেত। এখন জন্মের পর থেকে সবাই আগ্রহের সঙ্গে শিশুদের টিকাগ্রহণ করাই। তাও আবার একটি দুটি নয়- পর্যায়ক্রমে অনেকগুলো টিকা নবজাতক শিশু থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রহণ করতে হয়। একসময় এদেশে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগের বহুল নজির ছিল। বর্তমানে এই সংকটের প্রায় সকল চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। করোনা আতঙ্কের কালে ঘনঘন সাবান দিয়ে হাতধোয়ার অভ্যাস আমাদের গড়ে উঠেছে। আমাদের জীবনে সবচেয়ে জীবাণুবাহী উপাদান টাকা। টাকা ধরার পরপরই হাতধোয়ার অভ্যাসও ইতোমধ্যে অনেকেরই রপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করি। পরিচ্ছন্ন ও রোগমুক্ত জীবনের জন্য এ রকম আরও অনেক নিয়মকানুন আমাদের নৈমিত্তিক আচরণে যুক্ত হয়েছে। আমরা যেন এই আচরণগুলো করোনাতাণ্ডবের পর কোনোক্রমেই ভুলে না যাই।
পৃথিবীজুড়ে নেমে আসা ও ছড়িয়ে পড়া করোনাবালাইয়ের কার্যকর প্রতিষেধকের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। এই মহামারিরূপ বালাই থেকে পরিত্রাণের জন্য পর্যবেক্ষণনির্ভর কতগুলো ধারণা মানুষ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ধারণার অন্যতম অচেনা মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলা। নিজে পরিচ্ছন্ন থাকা এবং চারপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা। কিন্তু আমাদের দেশের নিদারুণ বাস্তবতা হলো নিজে নিজে অনেকেই পরিচ্ছন্ন থাকতে পারলেও চারপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা আশ্চর্য রকমের উদাসীনতা অবলম্বন করে থাকি!
করোনা আতঙ্ক সকলের মধ্যে। বিশ্বের উন্নত আর অনুন্নত সকল দেশের অন্তত এই একটি বিষয়ে ঐক্য আছে। উন্নত বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র এই আতঙ্কের যেন একপ্রকার ‘শিকার’-এ পরিণত হয়েছে। হিমশিম খাচ্ছে পরম শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ চীন ও জাপান। ইউরোপের অনেক দেশ আজ উদ্ভ্রান্ত দিশেহারা। নিত্যদিবসের এমন মৃত্যুও মিছিল বেঁচে থাকা মানুষকে অসহায় করে তুলেছে। একই রূপ অসহায়ত্বের সম্ভাব্য আতঙ্ক আমাদেরও আকণ্ঠ গ্রাস করেছে। করণীয় ঠিক করাই এখন কঠিন। এই সুযোগে আবার একশ্রেণির মানুষ দেশে দেশে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাধারণের জীবনযাপনকে কষ্টকরই শুধু নয় যন্ত্রণাদায়ক করে তুলছে।
এই সময়ে অনেকে না বুঝেই কিংবা সত্যতা অনুধাবন না করেই আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত নানা বিষয় শেয়ার করে চলেছে। বিপদের সময় গুজবও সত্য মনে হয়। আবার এ রকম সময়ে সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধিও কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায়। এটিও অস্বাভাবিক নয়। ভালো ফলের আশায় মানুষ কতকিছুই না করে। কিংবা প্রিয়জনদের জানানো প্রয়োজন তাগিদ অনুভব করে। তাই আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও করোনাভাইরাসকে আশ্রয় করে শাখায় প্রশাখায় বিস্তৃত ও পল্লবিত হয়ে চলেছে। এখানে যাচাইয়ের অবকাশ কম। আবার যেহেতেু এখনো জানা যায়নি করোনা বিস্তার রোধের সঠিক পন্থা তাই প্রতিরোধমূলক সতর্কতা অবলম্বনকারী অনেক ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি আমাদের নিতে হচ্ছে।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় সরকারি ছুটি, এরই ধারাবাহিকতায় কোয়ারেন্টাইন, এরই ধারাবাহিকতায় পরিচ্ছন্ন জীবনাচারের অনুশীলন। জাতীয় এই মহাদুর্যোগ ও মহামারি এড়াতে আমাদের জীবনাচার ও স্বভাবের পরিবর্তনের যে ইতিবাচক চর্চায় এতদিন অভ্যস্ত হলাম তা যেন দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর হয়।
এইচআর/বিএ/পিআর