মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ডাক্তারদের কথাও শুনুন!
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
গত তিন সপ্তাহের বেশি হলো আমার বাচ্চা দুটো স্কুলে যায় না। শুধু তাই নয়, এ সময়ে তাদের পড়াশোনাও মোটামুটি লাটে উঠেছে। এদিকে স্কুল থেকে অনলাইন টিচিংয়েরও ব্যবস্থা করেছে। গতকাল সকাল থেকে তাই তাদের পড়াশোনা নিয়ে বসেছি। সারাদিনে তেমন ফেসবুকে যাওয়া হয়নি। রাতে ঢুঁ+-* মারতেই দেখি ফেসবুক উত্তাল। ইনবক্সেও অনেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের অংশবিশেষের ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছেন। তিনি কী এমন বলেছেন যে ডাক্তারদের মাঝে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে?
বক্তব্যের শুরুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকসহ করোনা নিয়ে মাঠপর্যায়ে কর্মরত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, পুরস্কৃত করার কথা বলেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাযুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য ডাক্তারসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশংসা করা হচ্ছিল। বাংলাদেশের হাইকোর্টও তাদের ‘বীর’ বলে অভিহিত করেছে। সেই প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী বেশ কয়েকদিন ধরেই সরকারের কাছ থেকে এই ধন্যবাদটুকু আশা করছিলেন। চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীর কাজের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও তাই দেশের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ। তবে তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়নি, এইসব পুরস্কার ও ঝুঁকিবীমা শুধু সরকারি ডাক্তারদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কিনা? কারণ বাংলাদেশে এখন সরকারি ডাক্তারের চেয়ে বেসরকারি ডাক্তারের সংখ্যা বেশি, যাদের অনেকেই বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চাকরি করেন। আমরা আশা করবো, করোনাযুদ্ধে সামিল সরকারি-বেসরকারি সব ডাক্তারই এই প্রণোদনা এবং ঝুঁকি বীমার আওতায় আসবেন।
ধন্যবাদ জানানোর পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের বিষয়ে আরও কিছু কথা বলেছেন, যার ফলে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ কষ্ট পেয়েছেন। গতকালের ফেসবুক ঘাটলেই তা বোঝা যায়। একজন সামান্য রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিনি। অনেকদিন পরে গতকালের বক্তৃতায় চিরচেনা সেই তাঁকে খুজে পেলাম, যিনি অন্তরে যা আছে কোনরকম ভণিতা ছাড়া মুখে তা-ই বলে ফেলেন। করোনার এই দুঃসময়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে রোগীদের সেবায় যেসব চিকিৎসক নিয়োজিত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথায় তাদের কষ্ট পাওয়াটা যৌক্তিক। ঠিক একইভাবে বলা যায়, তিনি প্রদত্ত ভাষণে যতটুকু বলেছেন, একজন জনদরদী সরকারপ্রধান হিসেবে এটা বলাও কিন্তু স্বাভাবিক। একজন সরকারপ্রধান যখন পত্রিকার পাতা খুলে বড় বড় হরফে লেখা দেখেন, তিন-চারটা হাসপাতাল ঘুরে কোথাও ভর্তি হতে না পেরে একাধিক রোগীর মৃত্যু, তখন তাঁর পক্ষে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? পৃথিবীতে স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো গত আড়াই দশকে অনেক এগোলেও বাংলাদেশের সেইসব অগ্রগতির ছোঁয়া লেগেছে ছিটেফোটাই। আজও আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর ডাক্তার সমার্থক হয়ে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেকোনো দেশের স্বাস্থ্যখাতের ছয়টি অংশ থাকে যার নেতৃত্বে থাকে সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সুশাসন যেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ছয়টি অংশের একটি মাত্র অংশ হলো জনবল, অর্থাৎ ডাক্তারসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের সব পর্যায়ের মানুষই স্বাস্থ্যখাতের সব সীমাবদ্ধতার জন্য কেবল ডাক্তারদেরই অভিযুক্ত করেন যা অন্যায়, অন্যায্য। এ কারণেই বারবার পার পেয়ে যায় প্রকৃত ব্যর্থরা।
আমাদের সমস্যা স্বাস্থ্যখাত বা হেলথ সিস্টেমে। তা নিয়ে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর) এর মতো দু-য়েকটি সংগঠন ছাড়া তো কেউ কথা বলছে না। ডাক্তারদের যেসব বড় সংগঠন রয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে যেসব চিকিৎসক নেতৃবৃন্দের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে এসব প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলাপ করেন কিনা, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কর্তৃক করোনা নিয়ে আড়াই মাস লুকোচুরি ও তথ্য বিভ্রান্তির পরে মার্চের শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই হাল ধরতে হয়েছে। তিনি করোনার পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে সবাইকে সতর্ক করেছেন, করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন, দিচ্ছেন। এই করোনাযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা হলেন বাংলাদেশের ডাক্তাররা। মিডিয়ায় তেমন না এলেও আমরা জানি, ইতোমধ্যেই হাজার হাজার চিকিৎসক করোনাযুদ্ধে প্রথম কাতারে থেকেই লড়ছেন। অনেক ডাক্তারই এখন করোনা পজেটিভ। আইসিইউতেও কোভিড১৯ রোগী হিসেবে ভর্তি হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন কোনো কোনো ডাক্তার। এই মুহূর্তে তাই কোনোভাবেই এই চিকিৎসক বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেয়া যাবে না। সন্দেহজনক কোনো রোগীর করোনা পজেটিভ না নেগেটিভ, তা নিশ্চিত না করে কিছু রোগীকে যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি, তা মূলত হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্যান্য রোগীর নিরাপত্তার কথা ভেবেই করা হয়েছে। কদিন আগে আমার একটি লেখায় হাসপাতালে কেন কিছু রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি এবং সমস্যার সমাধানের বিষয়েও আলোকপাত করেছি।
করোনা বিষয়টাকে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর হালকাভাবে নিয়েছে। সম্ভাব্য দুর্যোগ চিন্তা করে তারা দেশের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ সাধ্য নিয়ে প্রস্তুত রাখেনি বরং তারা অনবরত অসত্য কথা বলে গেছেন, এমনকী এখনো বলছেন। তারা আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখেননি, বরং ঘটনা ঘটার পরে সমাধানে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রো-অ্যাক্টিভ নয়, বরাবরই তারা রিয়্যাক্টিভ আচরণ করেছেন।
দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর সবদেশেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার স্বার্থে ডাক্তারদের চেম্বার প্র্যাক্টিস সীমিত করা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ডাক্তারের কাছে যেতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর সাথে একাধিক অ্যাটেনডেন্টও যান। সে ক্ষেত্রে ব্যস্ত ডাক্তারের চেম্বারও হতে পারে নভেল করোনাভাইরাস ছড়ানোর এক উত্তম স্থান। এ কারণেই সবখানে এখন টেলিমেডিসিন সেবার গুরুত্ব বেড়েছে। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ, এফডিএসআরসহ বিভিন্ন সংগঠনের টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। এসব কিছুই করা হচ্ছে রোগীদের বৃহত্তর স্বার্থে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও করোনাযুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে এখনো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েছে না। অথচ সরকারের উচিত কিছু বেসরকারি হাসপাতালকেও নিজেদের আওতায় এনে কোভিড১৯ চিকিৎসায় সামিল করা। আর যেসব মানুষ করোনা চিকিৎসার যেকোনো উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা করবে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। এলাকায় কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করতে দেবে না, হাসপাতাল করতে দেবে না- এসব অযৌক্তিক আবদারকে শক্তহাতে প্রতিহত করতে হবে। প্রতিটা হাসপাতালে কার্যকরভাবে ট্রিয়াজ সিস্টেম স্থাপন করে প্রতিটা রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়ার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিভার ক্লিনিক’ একটি চমৎকার উদ্যোগ, তারা রোগীদের জন্য করোনা টেস্টও করছে।
হাসপাতালে এসে কোনো রোগী চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যাবে, সেটা যে কারও পক্ষেই মেনে নেয়া কষ্টকর। বাংলাদেশের চিকিৎসকরাও তাদের সর্বোচ্চ সেবাটুকু দিতে চায়, দিচ্ছে। তাদের এই নিবেদন স্বাস্থ্যখাতের ব্যর্থতার বলি হোক, এটাও কারও প্রত্যাশিত নয়। করোনাযুদ্ধে যদি ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কারও গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়, তার বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। সেটা নিয়ে আমাদের কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। জাতির এই দুঃসময়ে কোনো ডাক্তার যদি দায়িত্বে অবহেলা করে পালিয়ে বেড়ায়, উত্তর প্রজন্মের কাছে সে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবে। তাদের দায়ও আমরা কেউ বহন করব না। পাশাপাশি আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, অতীতের সকল দুর্যোগের মতো এবারও বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত থাকবে। রোগীদের বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা মাঝেমধ্যে কিছু দাবির কথা বললেও, দিনের শেষে সকল সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই আমাদের ডাক্তাররা কিন্তু জীবন বাজি রেখে হাসপাতালের রণাঙ্গনে লড়ছে। আর কিছু না পারি, আমরা এই চিকিৎসক যোদ্ধাদের যেন অন্যায্য সমালোচনার তীরে বিদ্ধ না করি।
সবশেষে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, স্বাস্থ্যখাতকে ঘিরে আপনার যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মহাপরিচালককে স্বপদে বহাল রেখে তা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব।
লেখক : চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর)।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ