করোনাভাইরাসের স্রষ্টা মানুষ না প্রকৃতি?
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত কোয়ারেন্টাইনে থাকা গোটা দুনিয়া। এই ভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব এখন খুব চলছে। একদলের ধারণা- চীন গবেষণাগারে করোনাভাইরাস বানিয়েছে। সারাবিশ্বকে শাসন করার ইচ্ছেতে নিজেদের কিছু মানুষ মেরে হলেও এই জীবাণু অস্ত্র বাকি দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে। প্রতিরোধকও প্রস্তুত। আর তাই খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে সব। এই ধারণার পক্ষে জোরালো যুক্তি হচ্ছে, চীনের উহান শহর থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে চীনের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য শহর বেইজিং, সাংহাইতে কেন ছড়ালো না? ওসব জায়গায় তো লকডাউন করার দরকার পড়েনি।
আরেক দলের মতে, করোনাভাইরাস আমেরিকার গবেষণাগারে বানানো হয়েছে। সারাবিশ্বকে শাসন করার ইচ্ছেতে আর কেউ যাতে হানা দিতে না পারে, সেই জন্য আমেরিকা এই জীবাণু অস্ত্র ছেড়েছে। আমেরিকার সেনাবাহিনীর একটি টিমকে কাজে লাগিয়ে চীনের উহান শহরে গোপনে করোনাভাইরাস ছড়ানো হয়েছিল। সিআইএ এ রকম অপকর্ম করতে সিদ্ধহস্ত, তার প্রমাণ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমার হামলা। এই মতের পক্ষেও জোরালো যুক্তি আছে। আমেরিকার ঘোরতর শত্রুদের ঘায়েল করছিল ভাইরাসটি। চীন। এরপর ইরান। এখন অবশ্য আমেরিকা নিজেও বেকায়দায় অবস্থায় পড়ে গেছে। পরের জন্য কুয়ো খুঁড়লে এ রকম বিপদ আসবে, জানা কথা।
গৃহবন্দি মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে সহজে। এরা খুব দ্রুত উদ্বিগ্ন হন। সহজেই ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব বিশ্বাস করেন। সহজেই রেগে যান। কেঁদে ফেলেন। গরম গরম স্ট্যাটাস দেন। ভাগ্যিস ফেসবুকটা ছিল। মনের রাগ ঝেড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে জগতের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা চলছে কিন্তু।
বিজ্ঞানীদের তো বসে থাকলে চলে না। শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের খুব দ্রুত এবং অসংখ্যবার পরিবর্তিত হয়ে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতার রহস্য মনোযোগ কেড়েছিল। ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদরাও ভাইরাসটির বারবার বদলে যাওয়াকে মনুষ্যসৃষ্ট হওয়ার প্রমাণ হিসেবে দেখছিলেন। এই মাসের মাঝামাঝিতে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বিজ্ঞানীরা জোর গলায় বললেন, না। করোনাভাইরাস গবেষণাগারে বানানো হয়নি। এর জিনগত বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ভাইরাসটি প্রকৃতির সৃষ্ট। ভাইরাসটির জিনগত গঠন চেনাজানা কোনো ভাইরাসের সাথে মিলছে না। তবে এ ভাইরাস প্রকৃতি থেকেই এসেছে। নেচার মেডিসিন পত্রিকার সাথে ১৭ মার্চ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গবেষক বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন এবং তার সহকর্মীরা এ কথাই বলেছেন।
আমেরিকান বিজ্ঞানী অ্যান্ডারসন স্ক্রিপস রিসার্স ইনস্টিটিউটে সংক্রামক রোগের গবেষক হিসেবে কাজ করছিলেন। চীনে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার খবর পেয়ে তিনিও অন্যদের মতো ভাবছিলেন ভাইরাসটির উৎপত্তির রহস্য নিয়ে। চীনের উহান শহরের সামুদ্রিক প্রাণী বেচাকানার মার্কেট থেকে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে বলে গবেষকরা ধারণা করছিলেন। ভাইরাসটি একজন মানুষের শরীরে প্রবেশের পর একজন থেকে বহুজনে ছড়িয়ে পড়েছে বলে গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে গবেষকরা বলছিলেন।
এক আমেরিকান রোগীর শরীর থেকে আলাদা করা করোনাভাইরাসকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলার পর পাওয়া যায় এমন চিত্র।
তবে এই বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতে ভাইরাসটির জিনগত গঠন সম্বন্ধে জানা যায়। চেনাজানা ভাইরাসের সাথে মেলেনি কোভিড-১৯ এর গঠন। তখনই এই ভাইরাস-বিষয়ক ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের পালে হাওয়া লাগে। বাদুড়ের শরীর থেকে জন্ম নেয়া ভাইরাসটিকে গবেষণাগারে ‘ভয়ংকর’ বানানো হয়েছিল এবং পরে তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে বলে আলাপ শুরু হয়। আর উহানের সেই সামুদ্রিক প্রাণীর মার্কেটটি উহান ভাইরোলজি ইনস্টিটিউটের খুব কাছে অবস্থিত বলে সেই আলাপের পালে হাওয়া লেগে যায়। আর এভাবে গবেষণাগার থেকে কখনো যেকোনো কিছু বেরিয়ে পড়েনি, তেমনও তো নয়। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে হতেও তো পারে সে রকম।
অ্যান্ডারসন শুরুতে সে রকম নিজেও ভেবেছিলেন। তবে, বিজ্ঞানী বলেই ভেবে ক্ষান্ত দেননি, বিবর্তনবাদ আর ভাইরাসবিদ্যা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে গড়ে তুললেন নিজের টিম। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল ভাইরাসের নমুনা। চেনাজানা কোনো ভাইরাস থেকে উদ্ভূত নয় এই ভাইরাস, এটা বোঝা গেল এর এ কদম আলাদা রাইবো নিউক্লিক এসিডের (আরএনএ) গঠন দেখে। সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানী এমা হডক্রফ্ট স্পষ্ট বললেন, মানুষ এখনো এতটা ভয়ংকর ভাইরাস বানাতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি, যে কিনা নিজেই নিজের বৈশিষ্ট্যকে ‘কাউন্টার’ করতে নিজের শরীরে বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়!
এমা হডক্রফ্ট অ্যান্ডারসনের টিমের বিজ্ঞানী নন, তবে করোনাভাইরাসের ছোট ছোট জিনগত পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করা নেক্স্ট্সট্রেইন ডট অরগ নামের আরেকটি টিমে কাজ করছেন, যারা করোনাভাইরাস কীভাবে ছোট ছোট জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে তার গবেষণায় ব্যস্ত। করোনাভাইরাসের কিছু কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য এইচআইভি ভাইরাসের সাথে মিলে যায় এবং বিবর্তনের কোনো পর্যায়ে এই দুটি ভাইরাসের পূর্বপুরুষ এক ছিল বলে আরেকটি গবেষণায় উল্লেখ করার পর তা নিয়ে হৈ চৈ শুরুর আগেই এমা হডক্রফ্ট-টিম ওই গবেষণার ভুল তুলে ধরে এই তত্ত্বকে বাড়তে দেননি।
বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন এবং তার টিমের গবেষণায় ধরা পড়ে, বারোটি অতিরিক্ত আরএনএ করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে ব্লক বা নিউক্লিওটাইড তৈরি করে এর শরীরে সেঁটে আছে। ব্লকের কারণে অতিরিক্ত চারটি অ্যামাইনো এসিড যোগ হচ্ছে এই স্পাইক প্রোটিনে, যা ভাইরাসের শরীর থেকেই তৈরি হচ্ছে এবং মানুষের কোষে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে। একই সাথে ফুরিন নামের একটি এনজাইম এই প্রোটিনের সাইটে তৈরি হচ্ছে। ফুরিন আরএনএ ব্লককে গুণিতক হারে বাড়তে দেয় না। সার্স এবং অন্যান্য সার্স-গোত্রীয় ভাইরাসের ক্ষেত্রে এরকম বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়নি।
যখন বার্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ফুরিনের সাহায্য পেয়ে গেল, তখন এটা আরও বেশি সহজে সংক্রমিত হচ্ছিল। এসব কিছুর সাথে এমন কিছু স্পট তৈরি হচ্ছিল, যেখানে চিনির যৌগসমূহ খুব সহজে স্পাইক প্রোটিনের সাথে জোড় বাঁধতে পারছিল, যা আসলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার থেকে ভাইরাসকে রক্ষা করার বর্ম বানিয়ে দিচ্ছিল। কোভিড-১৯ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন মানবকোষের প্রোটিনের সাথে আরও বেশি শক্ত বন্ধন তৈরি করে। এই শক্ত বন্ধনের ফলেই মানবকোষকে আরও সহজে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এ জন্যই কোভিড-১৯ এত বেশি বিপজ্জনক।
ফুরিন তৈরি হওয়া আর মানবকোষের প্রোটিনের সাথে আরও বেশি শক্ত বন্ধন তৈরি করার বৈশিষ্ট্য কীভাবে পেল ভাইরাসটি? গবেষণাগারে টিস্যু কালচারের সময় ভাইরাস অনেকবার মিউটেশন ঘটাতে পারে। কিন্তু প্রকৃতিতে মিউটশেনের পরিমাণ কমে যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়কে বিবেচনায় রাখার প্রয়োজনে। ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন এবং তার টিম সম্প্রতি প্রকৃতিতে পাওয়া অন্যান্য করোনাভাইরাসের সাথে কোভিড-১৯ ভাইরাসের তুলনা করলেন। এর ফলে জানলেন, এই ভাইরাসটি বাদুড় এবং বনরুইয়ের ভাইরাসের মিশ্রণ হতে পারে।
ভাইরাসসমূহ, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের মতো আরএনএ ভাইরাস প্রকৃতিতে প্রায়শই জিন অদলবদল করে। কোভিড-১৯ ভাইরাস আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত বনরুইয়ের শরীরে প্রাপ্ত ভাইরাসের জিনের গঠন সম্বন্ধে জানা ছিল না। কোন গবেষণাগারে কেউ এই প্রাণীর ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন বলেও জানা নেই বিজ্ঞানীদের। এখন বনরুইকে অসুস্থ করে ফেলা ভাইরাসটির ওপর গবেষণা করে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি যে পুরোপুরি প্রাকৃতিক, তা বুঝতে পারছেন। এর পেছনে ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ও তার টিমের যুক্তিগুলো কী?
মানবশরীরের প্রোটিনের সাথে দৃঢ়তর বন্ধন নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বনরুইয়ের শরীরেও অ্যামাইনো এসিড আছে যা স্পাইক প্রোটিনের সাথে দৃঢ়তর বন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রকৃতিতে এ রকম ঘটতেই পারে, বলেছেন বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন। চিনি-সম্পৃক্ততার এলাকা তৈরির বিষয়টিও প্রাকৃতিক। চিনি মিউকাসসমৃদ্ধ গ্লাইকোপ্রোটিনের বর্ম তৈরি করতে সক্ষম, যা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতার হাত থেকে ভাইরাসকে রক্ষা করে।
গবেষণাগারের টিস্যু কালচার ডিশের তো রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক সিস্টেম নেই, ফলে এ রকম বৈশিষ্ট্য গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটি গ্রহণ করেছে, তা বলা যাচ্ছে না। বাদুড় এবং বনরুইয়ের ভাইরাসের সাথে কোভিড-১৯ ভাইরাসটির মিল থাকা এর প্রাকৃতিক হওয়ার বড় প্রমাণ। পশু থেকে মানুষের শরীরে জীবাণু সংক্রমণের এটা বরঞ্চ আরেকটা প্রমাণ। তবে এই ভাইরাসের উৎস বাদুড় না বনরুই ছিল, তা নিয়ে দ্বিধা কাটেনি এখনো।
কী মনে হয়, করোনাভাইরাসের স্রষ্টা প্রকৃতি, এই তথ্য জানার পর ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব থেমে যাবে?
এইচআর/বিএ/পিআর