খুনিকে খুনি বলুন বেশ্যা নয়
অপরাধের কোনো নির্ধারিত লিঙ্গ নেই। অপরাধী হোক সে নারী কিংবা পুরুষ- শাস্তি একই মাত্রায় কাম্য। এক্ষেত্রে কোনো লৈঙ্গিকবৈষম্য কোনো অবস্থাতে কাম্য হতে পারে না। সকল প্রকার অপরাধী দেশের আইন অনুযায়ী যথাযথ শাস্তি পাবে, একটা দেশের নাগরিক হিসেবে এটা একটা স্বাভাবিক চাওয়া।আমাদের মতো আমজনতা অপরাধীর শাস্তি কামনা করবে এটাও খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু আজ এই টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে এসেও যখন নারী অপরাধীর শাস্তি কামনায় অশালীন শব্দ প্রয়োগের ছড়াছড়ি দেখি, তখন আমাদের মন ও মননের কলুষতাকে খিঁচে টেনে এনে সকলের সামনে মধ্যযুগীয় একজন বর্বরকে দাঁড় করিয়ে দেয়- এই বোধটুকু কার কবে হবে কে জানে!!
মানুষকে হেয় কিংবা হয়রানি করার জন্য আমাদের ভাষাসম্ভারে লিঙ্গভিত্তিক যতগুলো শব্দ রয়েছে তার প্রায় আশিভাগই নারীকে কেন্দ্র করে। এই সকল শব্দের নেই কোনো পুরুষ লৈঙ্গিক শব্দ। আর আমরা নারীকে হেয় করার জন্য সহজেই বেছে নিতে পারি সেইসব শব্দ। এতে করে আমরা এক ধরনের আত্মতুষ্টি পেয়েও থাকি। নারীকে অপরাধী হিসেবে দেখার চাইতে অশালীন শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে চরিত্রহীন নারী হিসেবে প্রমাণ করাটাই যেন কারও কারও কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
আবহমান কাল ধরে মানুষ তার অপরাধ প্রবণতা প্রমাণ করে আসছে। হতে পারে সে পুরুষ আবার হতে পারে নারী। কিন্তু দৃশ্যত লক্ষ্য করা যায় একজন পুরুষ যখন অপরাধ করে তখন তার জন্য শাস্তি চাওয়ার ভাষা প্রয়োগ একরকম। সেখানে তাকে সাধারণত তার অপরাধের দিকগুলো দেখিয়ে তার শাস্তি প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু একই অপরাধ যখন নারী করছে, তখন তাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা, তার শারীরিক বর্ণনা করা কিংবা তাকে বিবস্ত্র করে তোলাটাই যেন আসল কাজ হয়ে ওঠে।
এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে যেকোনো বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে শক্তিশালী মাধ্যম। ফেসবুক তার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। এখানে প্রায়ই দেখা যায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক শব্দগুলোই যেন কারও কারও কাছে বেশি পছন্দনীয়। যেন নারীর অপরাধ তার পোশাকে, তার শাড়িতে। যেন নারীর অপরাধ তার শরীরে। কোন মেয়ে কতগুলো শাড়ি কেমন করে গায়ে জড়ালো- এটা একটা আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
কোনো অপরাধী নারীকে নাঙ্গা করে রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেয়ার আহ্বান শোনা যায়। যেন তার শরীরই অপরাধের প্রধান উপজীব্য। কোনো নারী অপরাধীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া না করলে আমাদের যেন চলেই না। এক্ষেত্রে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করার চেয়ে তাকে বাজারী মেয়ে হিসেবে প্রমাণিত করতেই আমরা আদাজল খেয়ে লেগে পড়ি। তখন আসল ঘটনা থেকে সরে গিয়ে নারীর ব্যক্তিগত জীবন আর তার শরীরই হয়ে যায় অঢেল আলোচনার বিষয়।
আর যখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে উৎসুক জনতা এসে আগুনে ঘি ঢালে। কেউ কেউ ততক্ষণে বিবস্ত্রার শরীরে আরও অনেক উপমা প্রয়োগ করে এক ধরনের আদিম আনন্দ লাভ করে। ভেবে দেখেছেন কি, অপরাধীর শাস্তি দিতে গিয়ে এই ধরনের কার্যকলাপ আপনাকেও কিন্তু অপরাধী করে তুলছে!
শব্দনির্বাচন এবং শব্দচয়ন একজন মানুষের মানসিকতার পরিচায়ক। আপনি নিজে যখন এই ধরনের শব্দনির্বাচন করেন অন্যারা সহজেই আপনার মানুষ শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অমানুষটাকে প্রত্যক্ষ দেখতে পায়। আপনার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত শিক্ষাকে প্রমাণ করে আপনার প্রায়োগিক শব্দ। আর আপনাকে প্রমাণিত করে একজন কুরুচিপূর্ণ অপরাধী হিসেবে।
নারী যখন অপরাধ করে তখন সেই অপরাধটুকু ফোকাস করুন। খুনিকে খুনি বলুন বেশ্যা নয়। তার মানুষ হত্যা করার অপরাধের শাস্তি চান। তাকে নাঙ্গা করে চৌরাস্তার মোড়ে শরীর প্রদর্শন করানোর আবেদন জানাবেন না। নারী মিথ্যা বললে তার মিথ্যাচারের শাস্তি দাবি করুন। শাড়ি পরার পর তার শরীরের কতটুকু অংশ অনাবৃত রইল সেই আলোচনা থেকে বিরত থাকুন।
আদিম যুগ থেকে আমরা অনেক অনেক শতাব্দী পেরিয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসেছি। অনেক লড়াই করেছি সভ্যতার বিস্তারের জন্য। এখন এই যুগে এসে নিজেকে আবার বর্বর যুগে টেনে নিয়ে যাবেন না। অপরাধীর নির্ধারিত অপরাধের শাস্তি দাবি করে প্রমাণ করুন আপনি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।
নারীর প্রতি অশ্লীল শব্দ নির্বাচন আপনাকেও অপরাধী করে তোলে।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ