মহামারির মূল্য
আপাতত গোটা পৃথিবীতে সব বন্ধ। বিমান চলাচল প্রায় বন্ধ, পর্যটন স্তব্ধ, হোটেল, খাবার দোকান, কিছুই খোলা নেই। এমন চললে মে মাসের শেষের মধ্যে প্রায় সব বিমান সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা। পর্যটন-শিল্পেও একই কালো মেঘ। অন্যান্য শিল্প ও বাণিজ্যের অবস্থাও সঙ্গীন। করোনা-উত্তর পৃথিবীতে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর এখনও অজানা।
বলা হচ্ছে, মাস খানেকের মধ্যে পরিস্থিতির মোড় না ঘুরলে হয়তো এই বিশ্ব ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ এর সেই মহামন্দার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে। এই মহামন্দার চাপে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার শিল্প দেউলিয়া হবে। অস্তিত্বহীন হবে অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক বাজার।
সারাবিশ্বে মহামারির আকার নেয়া করোনাভাইরাস বাংলাদেশে কী প্রভাব রাখবে, তার কোনো পরিষ্কার চিত্র নেই। তবে বুঝতে পারছি সবাই যে, যা ভাবা হচ্ছে, বা ধারণা করা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হবে সেই প্রভাব। প্রধানমন্ত্রী রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যার সিংহভাগই নেবে পোশাক রফতানিকারকরা। ফলে এই প্যাকেজ নিয়ে খুব আশায় নেই অন্যান্য খাত। দেশের এভিয়েশন, পর্যটন, হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট মালিকদের মাথায় হাত পড়েছে। আর্থিক খাতসহ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে অবস্থা এখনও বিশ্লেষণের স্তরেই আসেনি।
বলা যায়, দুটি বড় সমস্যা নিয়ে এখন আমাদের সামনের দিন ভাবতে হবে। একদিকে অনেকদিন ধরে চলা বেকার সমস্যার তীব্রতা বাড়বে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে চলমান সীমাবদ্ধতাসমূহ যেমন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় না পৌঁছানো সত্বেও বড় বড় অনুন্নয় ব্যয় অব্যাহত রাখা ঠিক হবে কি-না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহসা খুলবে বলে মনে হচ্ছে না। টেলিভিশনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ শুরুর কথা বলছে কর্তৃপক্ষ, কিন্তু সেটা কতটা কার্যকরী হবে সবার জন্য সে নিয়ে দ্বিধা আছে। শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বড় আয়োজনের ভাবনা এখনই প্রয়োজন।
গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ হবে অনেক। সরকারি সংস্থা বিমানসহ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখান থেকে অনেকেই উঠে আসতে পারবে না। বিমান সরকারি হওয়ায় তার বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিন্তা নেই। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় বিমান কোম্পানিকে চালু রাখতে যে পরিমাণ ভর্তুকি জনগণের পকেট থেকে দেয়া হবে তা যে কত বড় হবে, সেটা অনুমানও করা যাবে না এখন। সাধারণ রিকশাওয়ালা, সিএনজিচালক, ঠেলাগাড়িওয়ালা, ভ্যানচালকসহ কত প্রান্তিক মানুষ আরও প্রান্তিক হয়ে কোথায় চলে যাবে জানা নেই।
এ মুহূর্তে কিছু জরুরি সেবা ছাড়া ব্যক্তিখাতের কর্মীবাহিনী অলস সময় পার করছে। তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ কতদিন বেতন দিয়ে যেতে পারবে সে এক বড় জিজ্ঞাসা। তবে জনগোষ্ঠীর যে অংশটি দিন আনে দিন খায় তাদের কথা কোনো প্রণোদনা প্যাকেজে উচ্চারিত হচ্ছে না।
রেস্তোরাঁ ব্যবসা বড় আঘাতে পড়বে। হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়ে পড়বে। রাষ্ট্র কি কোনো কিছু ভাবতে পারে এদের জন্য? একই অবস্থা হবে ছোট ছোট অনেক ব্যবসার ক্ষেত্রেই। বড় আর্থিক ঝুঁকির মধ্য পড়তে যাচ্ছে গণমাধ্যমও। এই সময় তথ্য দিয়ে সহায়তা করে, সরকারি উদ্যোগ প্রচার করে গণমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে, তাদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ আসা উচিত সরকার থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বিশেষ শাখা খুলতে পারে এই বিষয়গুলো নিয়ে। প্রকৃত তথ্যই পারে সহায়তার আসল পথে দেখাতে। নাজুক ও পিছিয়ে পড়া মানুষকে বাঁচানোর পন্থা বের করতেই হবে। টেলিভিশন টকশোতে ভাইরাস নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু এ বিষয়টি নিয়েও কথা তোলা প্রয়োজন।
এই সংকট আমাদের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। উন্নয়ন বলতে আমরা যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন বুঝেছি এতদিন, এবার সেদিক থেকে দৃষ্টি অন্য দিতেও নিতে হবে। রড-সিমেন্টের মাধ্যমে যা হয়েছে, তার পাশাপাশি হওয়া দরকার ছিল স্বাস্থ্যখাতে। আজ কত কী আছে আমাদের, কিন্তু এই কঠিন সময়ে আমরা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রটেকটিভ ইকুইপমেনটসহ সরঞ্জাম জোগাড় করতে হিমশিম খাই। উপসচিব পর্যন্ত প্রাইভেট গাড়ি কেনার টাকা দেই, খরচ দেই, কিন্তু হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহ করতে সক্ষম হই না। এসব অসক্ষমতাকে এখন বিবেচেনায় নিতে হবে।
আমাদের অর্থনীতির পেছনে সামাজিক শক্তির একটা ভূমিকা সবসময় আছে। সরকারের এখন কাজ হবে সেই শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা, ঐক্যবদ্ধ করা। এমনিতে অর্থনীতিতে ভাটার টান যে চলছে, তার একটি বড় কারণ যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব। বিনিয়োগ কম, কারণ বিনিয়োগকারীদের ভেতর যথেষ্ট আস্থা নেই। ব্যাংকিংসহ আর্থিক খাতে বড় কিছু অনিয়মের কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রেই শিল্প-বাণিজ্যের সহায়ক হতে পারছে। বিনিয়োগ বিশ্বাসের ব্যাপার। আজ বিনিয়োগ করলে ফল মিলবে কাল- এই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার কাজ করতে হবে।
ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসা মানুষের হাত ধরে গত প্রায় এক যুগে আমাদের অর্থনীতির যে জয়যাত্রা, মানুষের মনে যে উন্নয়ন স্পৃহা, অজানা ভাইরাসের ভয়ে ঘরের কোণে সিঁটিয়ে যাওয়া মানুষকে আবার তার প্রবৃদ্ধির গতিপথে ফেরত আনার বড় চ্যালেঞ্জ আগামীতে।
এইচআর/বিএ/এমএস