ধর্মের কোনো দোষ নেই, হজ নির্দোষ
মুক্তমনাদের নিয়ে বেশ মুশকিল ও ঝামেলা। তথাকথিত এই প্রগতিশীলেরা যে কোনো মন্তব্য করে বলে মুক্তচিন্তা। যে কোনো অকথা, আকথা, কুকথা বলে দাবি করে, এটি তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে কী এই যে, অন্যের সম্মান, বিশ্বাস, ঐতিহ্যে আঘাত করা? অন্যের ধর্মের অবমাননা করা? অন্যকে কোনোভাবে হেয় করার মধ্যে, ছোট করার মধ্যে, কটাক্ষ করার মধ্যে, রস-রসিকতা করার মধ্যে আর যাই থাকুক মুক্তচিন্তার ‘ম’ যে নেই এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ শব্দটিও কিছু লোকের হাতে পড়ে রীতিমত বিপথ ও বিপদগ্রস্থ। নিজের বা অন্যের ধর্ম সম্পর্কে হাস্যরস, অশ্লীল মন্তব্য, গালাগালকে বেশ কিছু লোক দাবি করছে বিজ্ঞানমনস্কতা। গালাগাল, আক্রমণ, অশালীন মন্তব্যের সঙ্গে কী সম্পর্ক বিজ্ঞানের? বিজ্ঞান তো দূরের কথা, আমি নিশ্চিত এ নেহাত মানসিক বিকারগ্রস্থতা। কারো ধর্ম বিশ্বাসের, ধর্ম পালনের অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অবিশ্বাস ও পালন না করার অধিকারও। কত লোকই তো ধর্ম পালন করেন না। বিশ্বাসও নেই। তাই বলে নিশ্চয়ই তার গাল দেয়ার, কুমন্তব্য করার, অশ্লীল আক্রমণের কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়, ধর্ম সম্পর্কে। বরং যারা মনে করে হাজার বছরের ধর্ম বিশ্বাস এক তুড়িতে উড়ে যাবে, উবে যাবে তারা নেহাত বোকা!
সৌদি আরবে হজব্রত পালন করতে গিয়ে পবিত্র মিনায় পদদলিত হয়ে প্রায় ৭’শর বেশি লোক নিহত হয়েছেন। অনেকে দাবি করছেন এই সংখ্যা নিদেন পক্ষে প্রায় ১২শ। নিহতের মিছিল বাড়ছে। হজে নিহত হবার ঘটনা নতুন নয়, এই প্রথম নয়। ১৯৯০ সালে মক্কায় পদদলিত হয়ে নিহত হন ১৪২৬ জন। ১৯৯৪ সালে মিনায় শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারতে গিয়ে নিহত ২৭০ জন। ১৯৯৭ সালে তাবুতে আগুন লেগে ৩৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৯৮ সালে মিনায় পাথর ছুড়ে মারতে গিয়ে মৃত্যু হয় ১৮০ জনের, পদদলিত হয়ে। ২০০১ সালেও মিনায় পদদলনের ঘটনায় মৃত্যু হয় ৩৫ জনের। ২০০৪ সালে মৃত্যু ঘটে ২৪৪ জন হাজির। ২০০৬ সালে শয়তানের প্রতি পাথর মারতে গিয়ে ৩৬০ এর অধিক হাজির মৃত্যু ঘটে। আর ক’দিন আগে ১১সেপ্টেম্বর হজ চলাকালে মক্কায় মসজিদুল হারামে ক্রেন ভেঙেপড়ে নিহন হন ১১১ জন।
যে ভাবে বুলডোজারে হাজিদের মৃতদেহ সরানো হচ্ছে সে দৃশ্যও বড় ভয়াবহ! আরব কেবল সৌদি বংশের একার নয়। আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদকে ইংরেজরাই বসিয়েছিল মসনদে, ক্ষমতায়। সৌদ রাজতন্ত্র ভাবছে আরব তাদের একার। ৮.৫ বিলিয়ন উপার্জনের দিক থেকেও অংকটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সঙ্গে রয়েছে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতা। আবার ইজরায়েল তার অনেক এজেণ্ডার সহচর। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুটো ধর্মীয় স্থানের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে দায়িত্বও তাদের উচ্চ আসনে তুলে দিয়েছে, ভৌগোলিক ও ধর্মীয় কারণে। মার্কিনিদের নেতৃত্বে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে এই রাজতন্ত্রের সমর্থনও লক্ষযোগ্য। পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর এই রাজতন্ত্রের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। সৌদি আরব শব্দটির সৌদি প্রিফিক্সের মধ্যেই আছে এক ধরনের ঊদ্ধত্য। এই ঊদ্ধত্যই তাদের বেপরোয়া করেছে। মানুষকে মানুষ না ভাবার, হজকে পণ্য ভাবার মানসিকতা গড়ে উঠেছে এখান থেকেই। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) বলেছেন, আরব ও আজমীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ আরব, অনারব কেউ আলাদা নয়। মোহাম্মদ (সা.) যেমন সকল সৃষ্ট জগতের জন্য রহমত স্বরুপ, তেমনি তার জন্মস্থানটিও সকল মানুষের জন্য রহমত। ফলে সৌদ বংশীয় বেদুইন বংশের নামে আরব ভূমিকে ব্রান্ডিং করা এক ধরনের উদ্ধত্যও বটে।
দেশটি নিয়ে নতুন করে বলবার কিছু নেই। দেশটির শাসকেরা, সৌদি বাদশাহজাদারা বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিরোধী ছিল। শুনে অবাক হবেন, দেশটি বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। যে দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
দেশটির শাসকেরা, বাদশাহজাদারা এই গণহত্যার দায় এখন হাজিদের ওপরই চাপাচ্ছেন। হাজিদেরই দায়ী করছেন। রাজনীতিও শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সৌদি আরব ও ইরান পরস্পর বিরোধেও জড়িয়েছে। মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের মহাসচিব আব্দুল্লাহ আল তারকি বলেছেন, কতিপয় দায়িত্বহীন ইরানী কর্মকর্তার অমূলক উক্তির লক্ষ্য হল সৌদি আরব ও তার নেতাদের ক্ষতিসাধন করা। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ‘সৌদি আরবের বিপক্ষে যারা বিবৃতি দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি নেই।’ সৌদি গেজেট ও আরব নিউজ ইতিমধ্যেই লিখেছে যে, ৩০০ ইরানি হাজি নিয়ম ভেঙ্গে চলাচল করতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। আবার বলা হচ্ছে, সৌদি বিরোধী প্রচারণায় নেমেছে ইরানপন্থী মিডিয়াও। দ্যা টেলিগ্রাফের এক সিনিয়র সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন যে, বাদশা সালমানের প্রাসাদের নিকটবর্তী এলাকায় দু’টি রাস্তার প্রবেশমুখ, ভিআইপি আগমনের কারণে পুলিশ আটকে দিয়েছিল আর সেটাই এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কারণ। এই অভিযোগকে নাকচ করে দেবার চেষ্টাও চলছে পরস্পরবিরোধী মিডিয়া ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে। তবে জেনে বিস্মিত হবেন গত ১১ সেপ্টেম্বর ক্রেন আছড়ে পড়ায় ১১১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় একটি কোম্পানিকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও সে ঘটনায় আদালতে কোনো একটি ব্যক্তিরও শাস্তি হয়নি।
তবে যত কথা, মন্তব্যের তীর ছোড়াছুড়ি হোক, শাকদিয়ে মাছ ঢাকবার কোনো সুযোগ নেই সৌদি আরবের। সৌদি রাজতন্ত্র, সৌদি সরকারের যথেচ্ছাচার, অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, অব্যবস্থাপনার কারণেই এই দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার দায় এড়াবার কোনো সুযোগ সৌদির নেই।
কিন্তু যারা, যে মুর্খরা, যুক্তিহীনভাবে এই ঘটনার বিশ্লেষণ না করে, গভীরে না গিয়ে ধর্মের সমালোচনা করছে, ইসলামের বিরোধিতা করছে, বলছে এই মৃত্যুর জন্য ইসলাম দায়ী তারা নেহাত মূর্খ ও যুক্তিহীন। বছর কয়েক আগেও লাঙলবন্ধে তীর্থ যাত্রায় গিয়ে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিলেন, প্রায় একইভাবে। এমন ঘটনা ভারতেও ঘটে। তীর্থযাত্রা, রথযাত্রায় মারা যায় মানুষ পদপৃষ্ট হয়ে। কিন্তু কোনো ধর্ম নিশ্চয়ই বলেনি, ব্রত পালন করতে আসা মানুষদের গতি রোধ কর, পথযাত্রার শ্বাসরোধ করে ব্রত পালনে আসা মানুষদের মৃত্যু নিশ্চিত কর। সেটি নিশ্চয়ই তীর্থ বা ধর্মের দোষ নয়, দোষ বা ত্রুটি যারা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন তাদেরই। মনে আছে, শেফিল্ড স্টেডিয়ামে ৪০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে লিভারপুল বনাম নটিংহাম ম্যাচে ১০০ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। সেখানে দোষ কাদের ছিল?
ভীড়ের মধ্যে চাপা পড়ে মৃত্যুর জন্য কোনো ধর্ম বা উপলক্ষ্য দায়ী নয়। দায়ী মানবিক অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা। হজ, ধর্ম, ইসলামকে যারা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন, অবিবেচকের মত মন্তব্য ছুড়ছেন তারা নেহাত বিজ্ঞানহীন, উর্বর মস্তিস্ক, কুতর্কপ্রবণ।
বরং আসুন সমবেদনা জানাই, আন্তর্জাতিক তদন্ত ও বিচার দাবি করি, ধর্মের বিষোদগার, সমালোচনা নয়। কেননা আমরাও হারিয়েছি আমাদের স্বজন- বাবা, ভাই, মা, বোন ।
লেখক : সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র। ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।
এইচআর/এমএস