ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

এই ডাক্তার লইয়া আমরা কি করিবো?

প্রকাশিত: ০২:৩৬ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঘটনা এমনটি ঘটতে পারে- আশঙ্কা ছিলো অনেকেরই। এই আশঙ্কাটা আসলে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। এমনটা দেখেই যে অনেক দিন ধরে অভ্যস্ত আমরা। তাই যেকোনো পরীক্ষা আসলেই তা পাবলিক হোক আর ভর্তি পরীক্ষাই হোক- প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কা পেয়ে বসে আমাদের। এবারও সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার আগে থেকে এমন গুঞ্জন শুনছিলাম আমরা অনেকেই। সেই গুঞ্জন যে কতটা সত্য তার প্রমাণ কিন্তু চাইলেই বের করা যায়। অন্তত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো অনেকগুলো প্রমাণ হাজির করেছে।

সেটা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা জানাতেই হোক আর পরিচিতদের খোঁজ-খবর নেয়া কিংবা সাম্প্রতিক ঘটনার ওপর নজর রাখা হোক। সব প্রয়োজনেই আমার মুঠোফোনে আমি ফেসবুকে সংযুক্ত থাকি ২৪ ঘণ্টা। কাজের ফাঁকে কিংবা অবসরে- নিউজ ফিডে চোখ বুলাতে ভুল করি না কোনো দিন। সেই অভ্যাসের কারণেই পেয়ে গেলাম একটা ফোনালাপের লিংক। মুঠোফোনের এক প্রান্তে কেবলই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়া একজন। অন্য প্রান্তে আরেক পরীক্ষার্থীর বড় ভাই। পরীক্ষার্থীটির কথায় স্পষ্ট প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার হলে পাওয়া প্রশ্নের মিল যে হুবহু সেটাও স্বীকার করতে শুনলাম তাকে। জানতে পারলাম জনপ্রতি ১৪ লাখ টাকা লেনদেনের কথা। এরপরও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দাবি, পরীক্ষার আগে বা চলাকালীন কোনো অনিয়ম বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি!

এরইমধ্যে আন্দোলনে নেমেছে এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়াদের একটি অংশ। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আরো অনেকেই হয়তো যোগ দেবে আন্দোলনে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আন্দোলনের দুইটি ফেসবুক গ্রুপও তৈরি হয়ে গেছে। আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম পরীক্ষার্থীদের অনুভূতির কথা। তাদের কষ্টের কিছুটা বুঝতেই চাইছিলাম। কিন্তু কয়েকটি ফেসবুক অ্যাকউন্টের স্ক্রিনশট দেখে চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ`র স্ট্যাটাস, `At last got chance at `DMC` ... ফাহিম, নাভিদ তোরা সকালে প্রশ্ন না দিলে মনে হয় না চান্স পেতাম, ... thnx man ...।`

আরেকজন লিখেছে, `ইয়েস মেডিকেল চান্স পাইছি। আমি বিশ্বাস করতে পারতেছি না। পিপারেসন খুব একটা ভাল ছিলো না। তবে রাতে প্রশ্ন পাইছিলাম। সেগুলা পড়ে গিয়ে দেখি সব কমন। ধন্যবাদ ছাত্রলীগের সদস্য মাহিন ভাইকে। তোমার জন্যই হলো। .............।`

শ্রাবণ আহমেদ জয় নামে একজনেরতো পরীক্ষার ফল পেয়ে পাগল পাগল দশা। অন্তত তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে সে এমনটিই প্রকাশ করেছে। লিখেছে, `Finally I got admitted in #DMC.... prosno paoate onk upokar holo amar life er.....but price kintu 15 lack........`

এসবের পরও কি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী দাবি করবেন কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি? নাকি দাবি করবেন, ফেসবুকে যারা এসব লিখেছেন তার সবই ভুয়া? নাকি তার এই দাবি বিশ্বাস করবো আমরা? সরকারের অবস্থান থেকে প্রতিমন্ত্রী এমন দাবি করতেই পারেন। আর সাধারণ জনতাও তাদের মতো করে যা বোঝার বুঝে নিতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশে সবারই ভাবনা এবং বোঝার স্বাধীনতা আছে। এটাতো সবারই জানা, সরকারি কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে আধুনিক ডিভাইসসহ আটক করেছিলো র‌্যাব। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল অনিয়ম ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তাতে ভিত্তি পেয়েছে বেশি করে।

তবে একদিন পরই ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ নাকচ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। জানানো হয়, ১১ হাজার ৪৯টি আসনের বিপরীতে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে ৪৮ হাজার ৪৪৮ জন। অর্থাৎ পাসের হার ৫৮.৪০%। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দাবি, পরীক্ষার্থীরা ভালো পরীক্ষা দিয়েছে বলেই এবার ভালো ফল হয়েছে।

আসলেই কি বিষয়টি সেরকমের? সে পরীক্ষার্থী  মাত্র ২০ দিনের প্রস্তুতিতে পরীক্ষা দিয়েছে তার পরীক্ষাতো ভালো হওয়ার কথা নয়। হয় সে আমাদের কল্পনার চাইতেও বেশি মেধাবী; নয়তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের কল্যাণে তার মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়া। তার নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাস কিন্তু দ্বিতীয়টির প্রমাণ দিচ্ছে।

যে সাড়ে ৫৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী এবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো তার সবাই কিন্তু ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের কল্যাণে এই সুযোগ পায়নি। এদের মধ্যে কতজন পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র পেয়েছেন তার পরিসংখ্যান বের করা কঠিন। আবার এমনও হতে পারে এদেরই অনেকে হয়তো সত্যিকার অর্থেই মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়ার মতো মেধাবী। শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাবেই তারা অনৈতিক পথে গেছে। কিন্তু ৪৮ হাজার ৪৪৮ জনের মধ্যে কে নিষিদ্ধ পথে না হেঁটে নিজের মেধার জোরে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তা কি করে জানবো? এদের প্রত্যেককেই দেখলে সন্দেহ হবে- হয়তো এই ছেলেটি বা ওই মেয়েটি আগেই প্রশ্ন হাতে পেয়েছে। এই সাড়ে ৪৮ হাজার হবু চিকিৎসকের ওপর কিন্তু আস্থা রাখতে পারছে না কেউই।

সত্যিকারের মেধাবী হয়েও প্রশ্নফাঁস চক্রের কারণে যারা বঞ্চিত হলো তাদের কী হবে? বঞ্চিত বললেও হয়তো পুরোটা বোঝানো যাবে না। এই শিক্ষার্থীরা আসলে প্রতারিত। কয়েকজন প্রতারকের কারণে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলো না তারা। এদের কেউ কেউ আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে ভর্তি হবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। তেমন সামর্থ্য না থাকলেও হয়তো বাবার পেনশনের টাকা কিংবা ফসলি জমি বিক্রি করবে অনেকে। মহাজনের কাছ থেকে  হয়তো চড়াসুদে নেবে টাকা। কারণ ওই শিক্ষার্থীদের আজীবনলালিত স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়া। যারা পারবে না স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বয়ে বেড়াবে সারা জীবন।

যারা প্রতারিত হয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়বে তাদেরও হয়তো মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে মাঝেমধ্যেই। কারণ আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ফার্মের মুরগী হিসেবেই দেখে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাস করার পর কি হবে? তখন কি কেউ জিজ্ঞেস করবে এই চিকিৎসক কোন ব্যাচের? তার ভর্তি পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিলো কি? সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছে? এদের পাস করে বের হতে লেগে যাবে আরো কয়েক বছর। কিন্তু আগামী কয়েক মাসেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব কিছু। শুধু অস্বাভাবিক থাকবে প্রতারিত শিক্ষার্থীদের মন। যে মনগুলোতে ক্ষণে ক্ষণে জমাট বাঁধবে কালো মেঘ।

সময়ের ভেলায় ভেসে এই মেঘও একদিন ভেসে যাবে অনেক দূরে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে শেখা শুরু করে দেবে এই শিক্ষার্থীরা। এরাই হয়তো অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে বিশ্ব দরবারে। তাতেই কি স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবকিছু? আজ প্রতারিত হলো কয়েক হাজার পরীক্ষার্থী। কিন্তু আগামীর বাংলাদেশে যে কয়েক লাখ কিংবা কয়েক কোটি রোগীর প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের সুযোগে যে তরুণ একদিন চিকিৎসক হবে সে কিভাবে সেবা দেবে এই দেশের মানুষকে? রোগ নির্ণয়ের সময় কি তাকে ফাঁস করা কোনো উপায়ের খোঁজে থাকতে হবে? নাকি রোগীর কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন লক্ষণ আর বিবরণ দিয়ে গুগল ডটকমে খুঁজতে হবে অসুখ? আর ওষুধের জন্য হয়তো পাঠিয়ে দিতে হবে কোনো প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছে।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আজ যারা অনৈতিকভাবে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলো আগামী বছরগুলোতে তারা অনেক কষ্ট করে, অনেক লেখাপড়া করে সত্যিকার চিকিৎসক হিসেবেই পাস করে আসবে। অন্ধকার পথে হেঁটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মানুষটি কিন্তু পরবর্তীতে কঠোর পরিশ্রম করে একাডেমিক পরীক্ষাগুলোতে সেরা হতে পারে। এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না কোনোভাবেই। কিন্তু তাদের মনুষ্যত্ব আর চারিত্র্যিক গঠনের ওপর কি আস্থা রাখা যায় কোনোভাবে? এমন মানসিকতার একজন চিকিৎসক কি রোগীর সেবা দেবে নাকি রোগের ব্যবসা করবে? এমনিতেই নানা ধরনের অব্যবস্থাপনায় কাহিল এ দেশের স্বাস্থ্যসেবা। সরকারি-বেসরকারি কোথাও মেলে না সঠিক সেবা। কয়েকটি জায়গায় হয়তো ব্যতিক্রম পাওয়া যাবে। কিন্তু গড়পড়তা স্বাস্থ্যসেবার মান খুব একটা ভালো না। আর বেসরকারি বেশিরভাগ হাসপাতালেইতো স্বাস্থ্যসেবাটা হেরে গেছে স্বাস্থ্য-ব্যবসার কাছে। এমন অবস্থায় চোখের সামনে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছে বেশ কিছু অসৎ এবং অনৈতিক স্বভাবের চিকিৎসক। এই চিকিৎসক দিয়ে এই দেশের কি হবে?

বাংলাদেশে শিক্ষার ইতিহাসে যোগ করলো আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই ভর্তি পরীক্ষা মেধাবীদের ঠেলে দেবে সীমাহীন হতাশার দিকে। এই ভর্তি পরীক্ষা আসলে এ দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের বিষয়টিকেই প্রকট করলো। অথচ এ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কারো কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাই যদি হতো তাহলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো না। এসব দেখে আসলেই স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ হতে হয়। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, কোন নিঃসীম অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আজকের প্রজন্মকে? এর শেষ কোথায়? তাও কি জানা আছে কারো?

লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]

এইচআর/পিআর