ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বার বার তারা কেন জয়ী হবে?

প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এই যে লিবিয়া ইরাক এবং সম্প্রতি সিরিয়া থেকে দলে দলে মানুষ দেশত্যাগী হয়ে পাড়ি দিচ্ছে তার মূলে গেলে কোন চেহারাগুলো ভেসে উঠবে তা যেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারছে না। ব্রিটেন ওদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অনুদার মনোভাব নিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমের সুইডেন দুয়ার খুলতেই নারাজ। ফ্রান্সও দুয়ার এঁটে বসে থাকতে চাইছে। জার্মেনি-অষ্ট্রিয়ার সরকারি ঔদার্য অবাধ ছিল না, উদ্বাস্তুর সংখ্যা লাখ ছোঁয়ার আগেই তটস্থ হয়ে ওরা সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে। মনের কথা খুলে বলেছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী- মুসলমান উদ্বাস্তু নিতে তাঁর আপত্তি আছে। তাঁর মনোভাব হচ্ছে তাঁরই মত পুরো ইউরোপেরও আপত্তি থাকা উচিত।

লিবিয়া ইরাক সিরিয়া থেকে হঠাৎ বাঁধভাঙা ঢলের মত দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে কেন? আর কেউ না বুঝলেও ইউরোপেরই তো জানার কথা।

তিনটি দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে কারা? এসব অঞ্চলে যে আইএস আর আইএসআইএল নামে মুসলিম জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি হয়ে মানবতা ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে কারা? কারাইবা তৈরি করেছিল আল-কায়েদা, তালেবান? কারা পেছনে ছিল ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ওমর অথবা জওয়াহিরি-বকরদের উত্থানের পিছনে? একটু খবরাখবর যারা রাখেন তারা অবশ্যই জানেন কোন দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি অস্ত্রব্যবসায়? মানুষ এও জানে ডব্লিউএমডি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র মওজুদের অজুহাত তুলে কারা স্থিতিশীল দেশ ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দামকে হত্যা করে ইরাকে বর্তমান গৃহযুদ্ধের নৈরাজ্য সৃষ্টির মূলে। মানুষ জানে গণতন্ত্রের নামে লিবিয়া-আফগানিস্তানে উপজাতীয় বিবাদ উসকে গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি করেছে কোন মিত্রশক্তি। আজ সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে হটানোর নামে কারা সে দেশের স্থিতিশীলতা ভেঙে দিয়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে? তা কি কারো অজানা? আজকের ইউরোপ অভিমুখি উদ্বাস্তু পরিবারগুলো তো এসব গৃহযুদ্ধেরই বলি।

অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রই এই মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির মূল কারিগর। ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মেনি মৈত্রী সূত্রে গণতন্ত্রের নামে এসব আগ্রাসনে অংশ নিয়েছে। সুইডেন খুচড়ো অস্ত্রের ব্যবসায়ে শীর্ষদের অন্যতম। কে না জানে গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত হয় এরকম অস্ত্রই। আইএসের কাছ থেকে কিংবা দস্যুতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর কাছে থেকে তেল কিনছে যে সব বহুজাতিক কোম্পানি তাদের মালিকানা কাদের সেসবও সবারই জানা। আর ইতিহাসের পাতা ধরে পিছিয়ে গেলে জানা যাবে কীভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্স-স্পেন-পর্তুগাল ছাড়াও হল্যান্ড-বেলজিয়ামের মত ছোট ছোট ইউরোপীয় দেশও একসময় এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে হামলে পড়েছিল। আমরা জানি কী পাশব নৃশংসতায় তারা সব লুটে নিয়েছে উপনিবেশগুলোর। ছোট্ট প্রশ্ন- আজ পর্যন্ত সেসব বহুজাতিক কোম্পানির আড়ালে তেল ও অন্যান্য খনিজের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখছে কারা? মানুষ তো সব জানে। ইউরোপের বিত্ত, ঐশ্বর্য আর নাগরিকদের উচ্চমানের জীবনের পিছনে বিপুল পুঁজির যোগান এসেছে কীভাবে সে ইতিহাস আজ কারো অজানা নেই।

পালের গোদা আজ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যথেষ্ট ধূর্ততার সঙ্গে কাজ চালাচ্ছে। দেখুন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে কতকগুলোতে সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত প্রভৃতিতে আছে তাদের বশংবদ সরকার। সেখানে নিজেদের স্বার্থে তেলের ব্যবসা চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অতএব এসব দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার বহাল থাকলেও  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো তাগিদ তাদের নেই, মানবাধিকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই। উত্তর আফ্রিকা ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও আধুনিক জীবনব্যবস্থায় অগ্রগামী ছিল লিবিয়া ও ইরাক। তদুপরি এ দুটি দেশের সরকার-প্রধান সাদ্দাম হোসেন ও মুয়ামার গাদ্দাফি ছিলেন স্বাধীনচেতা, এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তাই এসব দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম অস্থির হয়ে পড়েছিল। সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দেশ দুটি তছনছ করে দিয়েছে। ইরান আর সিরিয়াকে বাগে আনতে না পেরে বড়ই পেরেশানে  আছে পশ্চিম। অবশেষে সিরিয়ার ব্যাপারে ধৈর্য রক্ষা করা গেল না। আক্রমণে এগিয়ে এলো আইএস- স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছে পশ্চিমের।  আর এরই খেসারত হিসেবে এত মানুষের ঢল ইউরোপ অভিমুখে। যুক্তরাষ্ট্র জানে উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তার দেশে ঢোকা সম্ভব নয়। যদি যায় তো ভূমধ্যসাগর অথবা তুরস্ক হয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবে মানুষ। ফলে তার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না।

সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু ঢলকে এসব অঞ্চলে পশ্চিমের হস্তক্ষেপ ও ভুল নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু এও আমরা জানি জাতিসংঘ বলুন আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা শরণার্থী কমিশন বলুন সর্বত্রই ওদের স্বার্থ বিবেচনার মানুষ রয়েছেন। তদুপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থকরাই পাল্লায় ভারি। তারা তো শক্তি ও বিত্তের জোরে বিশ্বব্যবস্থাটা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে।

পশ্চিমা উন্নত জীবন ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন  দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যই শুধু নষ্ট করা হয় নি, তৃতীয় বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে এতে। গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে একমেরু বিশ্বের নেতারা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশকেই শক্ত স্বাধীন অবস্থানে থাকতে দিচ্ছে না। এভাবেই ভেঙে গেছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের, শক্তিহীন ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা, আরব লীগ, ওআইসির মত সংগঠনগুলো। বরং ডব্লিউটিও এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর ভূমিকা জোরদার করে পশ্চিমই এককভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে এসেছে।

আমার তো মনে হয় মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষার জন্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের উচিত হবে জাতিসংঘের পাশাপাশি নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জাতিসংঘ গড়ে তোলা। ইউএনওর পাশাপাশি ইউএনএএ বা ইউনাইটেড ন্যাশনস্ অব এশিয়া অ্যান্ড আফ্রিকা গঠিত হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে চীন যেভাবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে তেমন সব উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে চীন এসব উদ্যোগে ভারত ও জাপানকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে। তাতে অগ্রগতিও আছে, যুক্ত হবে রাশিয়া যেদেশটি ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে আছে। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ হতে পারে।

এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এইসব দেশের বিকল্প শক্তি দাঁড় করাবার সামর্থ্য রয়েছে। এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে, ক্ষমতার স্থিতি নষ্ট হতে থাকলে সন্দেহ করতে হবে যে তার পেছনে পশ্চিমের স্বার্থান্ধ সাম্রাজ্যবাদের হাত আছে কিনা। কারণ, অতীতের এবং সাম্প্রতিক কালের সব ঘটনার পেছনেই তাদের হাত ও কারসাজি তো জলজ্যান্ত সত্য বিশ্ববাসীর সামনে। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি মানুষ মানবিক ও উদার হলেও রাষ্ট্রশক্তি শেষ পর্যন্ত স্বার্থান্ধ হয়ে পড়ে।

ফলে আরও সাবধানতা দরকার। ওরা বারবার ধর্মের কার্ড খেলে চলেছে, উত্তরোত্তর কট্টর জঙ্গি পন্থীদের ভরসা করছে ও উসকে দিচ্ছে। মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বুলি আওড়ালেও এসব কি কোথাও তারা বাস্তবায়ন করেছে, করতে পেরেছে যেসব দেশে হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে আর লাখ লাখ মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছে এর খেসারত হিসেবে? না, তারা পারেনি, কারণ গণতন্ত্র রফতানি-যোগ্য পণ্য নয়। একইভাবে মানবাধিকার বা আইনের শাসনও রফতানি করা যায় না। তা সংশ্লিষ্ট জনগণকেই অর্জন ও আদায় করতে হয়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে সে প্রক্রিয়াকে তারা বরং ব্যাহত করেছে।

ধর্মের আফিমের মত ব্যবহার গরিব দেশে এখনও কার্যকর- এটা মস্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। উগ্র ও জঙ্গি ধর্মপন্থার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন কায়দায় ঠিকই তার স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে। এতে মানুষের সত্যিকারের ধর্মবোধ, মানবিক নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অযথা বিঘ্ন ঘটছে। সাম্রাজ্যবাদ অবশ্যই বরাবরই চতুর ধূর্ত খেলোয়াড়। কিন্তু বারবার তারাই জয়ী হবে?

লেখক: কবি, সমাজচিন্তাবিদ

এইচআর/আরআইপি