ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্ল্যাকার্ডের ভাষা: ‘আই ডোন্ট নিড সেক্স..’

প্রকাশিত: ০৬:৫৪ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শিক্ষক হিসেবে নিজের চোখে দেখছি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাতে কল সেন্টারে জব করে দিনে কত ক্লান্তি নিয়ে ক্লাস করছে। এক ছেলেকে দেখেছি ফেইসবুকে অনলাইন শপ খুলে বাসাবাড়িতে গিয়ে মেয়েদের থ্রি-পিস ফেরি করে নিজের খরচ যোগাচ্ছে। দেখেছি একটার পর একটা টিউশনি করে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েটা, মেসে থেকে, কী সংগ্রাম করছে তার টিউশন ফি যোগাতে। আমি ওদের এই সংগ্রামকে শ্রদ্ধা করেছি মনে মনে। কারণ আমি জানি এখন খুব কম সংখ্যক ধনীর সন্তান দেশীয় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ উচ্চ মধ্যবিত্ত আর বাকিটা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সন্তানরা পড়ছে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। ধনীরা যাচ্ছে বিদেশে।

এই সব ছেলে-মেয়েরা আন্দোলন ছাড়া, রাজপথ দখল ছাড়া- সরকারের অন্ধত্ব কি করে ঘুচাবে- যারা ধারণাই করে আছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শুধু ধনীর ছেলে-মেয়েরা পড়ে! রাজপথ দখল না করে তারা গত ৩ মাস ধরে আন্দোলন করেছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। সরকার কি তাদের নিয়মতান্ত্রিক আবেদন-নিবেদনকে তোয়াক্কা করেছে? তাদের বিরুদ্ধে এই ভ্যাট জুলুম তুরস্কের সমুদ্র তীরের পড়ে থাকা শিশু আয়লানের মৃত্যুর মতোই করুণ বিষয়। ছাত্রদের ওপর সরকার অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর চেষ্টা করছে। তারা তা সরানোর কথা বলছে। এখানে অন্যায় কি? সরকারের আমলা, মন্ত্রী এবং তাদের সুসময়ের বন্ধুদেরতো জানার কথা নয়- কত বড় অর্থনৈতিক বোঝা মাথায় নিয়ে তারা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। তাদের বাবা-মা মাথার ঘাম কিভাবে পায়ে ফেলে এই টাকার ব্যবস্থা করছে।

মুহিত সাহেবের কথা শুনলে মনে হয়- রাজকীয় ফরমান যেটা জারি হয়ে গেছে সেটা প্রত্যাহার হয় না। একের পর কথা পরিবর্তন করছেন কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনও কথা বলছেন না তিনি। বরং এবার না হলে আগামীবার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। আর রাজপথের অসন্তোষ, শান্ত শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করে চলছেন।

শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট আরোপ যে একটা বিবেকহীন কাজ শুধু তাই নয়, এটা ভ্যাটের মূল নীতিমালারও বাইরে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিত সাহেব এবং তার আমলাদের কর আরোপের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের ব্যর্থতা ঢাকতে, সরকারি কর্মচারিদের দ্বিগুণ বেতন জোগাতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা বলি হতে পারে না। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের তিনি আগেই বলি করে রেখেছেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১০ লাখ লোক ট্যাক্স দেয় মাত্র। এটাইতো বুঝা যায়, যে মুরগীদের ধরেছেন তাদেরকেই বার বার জবাই করে পারফরমেন্স দেখাচ্ছেন তিনি এবং তার সাঙ্গাতরা।

যেসব মন্ত্রী, আমলা এবং তাদের অন্ধ সমর্থকরা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন তারা তাদের বিরোধিতার পক্ষে কোনও যুক্তি দিচ্ছেন না। তারা বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের, শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননে লিপ্ত হয়েছেন। চরিত্র হননের একটা মোক্ষম অস্ত্র দেখছি গত কয়েকদিন ধরে- আন্দোলনে প্ল্যাকার্ডের ভাষা নিয়ে। একজন নারীর হাতে ঢাকাই সিনেমার ডায়লগের অনুকরণে বানানো প্ল্যাকার্ডের বক্তব্যকে তারা ভিন্ন কিছু ভাবতে পারছেন না। ‘দেহ পাবি, মন পাবি, বাট ভ্যাট পাবি না’-এই শ্লোগানকে তারাও ভাবছেন সিনেমার ভিলেনের মতো করেই। বিবেচনায় নিচ্ছেন না- এটা মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের কৌশল বা জাস্ট ফান। হয়তোবা এসব শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে  অনভ্যস্থতার ফসল এগুলো।

Novat

প্ল্যাকার্ডের ভাষা নিয়ে নিন্দায় যুক্ত হয়েছেন দেখছি অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি। সাংবাদিক থেকে অভিনেতা হওয়া বন্ধু হাসান মাসুদের মন্তব্যটা যুতসই মনে হচ্ছে উদাহরণের জন্য। কারণ তিনি নিজেও আবার এই ভ্যাট দিয়ে আসছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বিরোধী এক স্ট্যাটাসে তিনি যে কমেন্ট করেছেন তার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়- “এ আর (টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট) নতুন কি। আমি সাড়ে ৪ শতাংশ করে আমার সন্তানের টিউশন ফি’র সঙ্গে ক্লাস ফাইভ থেকে এটা দিয়ে আসছি। গত বছর এটা সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে এবং আমরা নিয়ম মেনে তা পালন করে আসছি। আমার মনে হয় এইসব শিক্ষার্থীরা স্বার্থান্বেষী মহল দ্বারা পরিচালিত। আমি খুব মর্মাহত যেসব ভাষা তারা ব্যানারে ব্যবহার করছে। তারা শিক্ষার্থী হতে পারে না। যদি হয় তাহলে তাদের লালন পালন লজ্জাকর।”
তাহলে দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতার চেয়ে তাদের প্ল্যাকার্ড/ব্যানারের ভাষা মুখ্য হয়ে গেছে অনেকের কাছে। ওদের প্ল্যাকার্ডের ভাষা পছন্দ নয়, তাই তাদের দাবিও সমর্থন করতে পারি না। অর্থটাতো এমনই দাঁড়ায়। যারা প্ল্যাকার্ডের ভাষায় মনে কষ্ট পেয়েছেন তাদের জন্য তারকা উপস্থাপক আব্দুন নূর তুষারের একটা বক্তব্য আমি শেয়ার করছি। এটা সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, তারপরও প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে এখানে। তিনি লিখেছেন-

“একজন নারীর হাতে একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা কিছু শব্দ নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছেন এমন কিছু লোকজন, যাদের দেখেছি প্রকাশ্যে গালাগাল দেয়া লোকজনকে সমর্থন দিতে! এদের নৈতিক মানদণ্ডের পরাকাষ্ঠা হলো, নিজের পক্ষে গালি হলে তালি বাজায়, আর বিপক্ষে একটি শব্দের নৈতিকতা নিয়ে হুজ্জত করে!

মেয়েটি নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছে, কিন্তু এটা তাদের মনপুত নয়! মেয়েটির মন, দেহ এবং টাকা, কোনোটাই কি অন্য কারো অন্যায় ভাবে নেবার অধিকার আছে? সে এগুলো কাকে দেবে বা দেবে না সেটা বলবার অধিকার তার নিজের!
তর্ক হতে পারে এটা নিয়ে যে কেবল বেসরকারি উচ্চ শিক্ষায় ভ্যাট আরোপ কি ২০২১ সালে মানবসম্পদ, তরুণদের বাংলা তৈরির স্বপ্নের সাথে যায় কিনা? তর্ক জুড়ে দেয়া হয়েছে প্ল্যাকার্ড নিয়ে! প্ল্যাকার্ড এর ভাষা সঠিক কি বেঠিক তার সাথে ভ্যাট এর যৌক্তিকতার কি সম্পর্ক? যদি একজন পুরুষ এই প্ল্যাকার্ড ধরত, তখনতো রংধনু মেরে প্রোফাইল দিতেন অনেকেই!

এই ছেলেমেয়েরাই তরুণ ভোটার, এদের প্রতি সদয় হয়ে, ভ্যাট এর যৌক্তিকতা বুঝানো দরকার! রাষ্ট্র, সরকার চালাতে তাদের অংশগ্রহণ দরকার, সেটা বুঝানো দরকার! উচ্চ শিক্ষায় কর আরোপ করে young দের বাংলাদেশ গড়ে তোলা কি আসলেই সম্ভব?”

আমাকে কাল আরেকটি ছবি ইনবক্স করেছে এক বন্ধু। এক তরুণ একটি প্ল্যাকার্ড ধরে আছে। তাতে লেখা- “৫২ তে রাজাকাররা খুন করেছে, এখন কি তোরা করবি? খুন কর ভ্যাট দিমু না।”

এটাতেও হয়তো অনেকে হাসাহাসি করছেন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের জ্ঞানের বহর দেখে। কারণ ’৫২কে আলাদা বক্স মার্ক দিয়ে ইন্টারনেটে ছেড়েছেন তারা। কিন্তু কেন? আমি যদি ছাত্র হিসেবে পুলিশের সামনে এটা তুলে ধরি, ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করি, ভুলটা কোথায়? ’৫২ সালে নুরুল আমীনরা কি ছাত্রদের খুন করেননি? নুরুল আমীন কি নিজেকে রাজাকার প্রমাণ দেয়নি? জিন্নাহর মাজারের পাশেইতো এখনও শুয়ে আছেন তিনি। গোলাম আযম যদি ’৭১ সালের অপকর্মের জন্য রাজাকার হন, ’৭১সালে একই কাজের জন্য নুরুল আমীন রাজাকার হবেন না কেন? তিনিতো ডবল রাকাজার। যে রাজাকার সে সব জন্মেই রাজাকার।

শ্লোগান আর প্ল্যাকার্ডের ভাষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক গীতিআরা নাসরিনের  বক্তব্যটি রসিকতাপূর্ণ। তিনি লিখেছেন-

“প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহৃত শ্লোগান বেশ একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবিরাও যে এ আন্দোলনের শ্লোগান কি হওয়া উচিৎ তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, এটা কিন্তু বেশ আশার কথা! তার মানে তারা "নো ভ্যাট" আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। নো ভ্যাটের শ্লোগানগুলো আন্দোলনের মতোই স্বতঃম্ফূর্ত, তাই নিশ্চয়ই `সহি স্লোগান` হয়ে ওঠেনি। এনিয়ে চিন্তা-ভাবনা, পরামর্শ দান চলতেই পারে।

শ্লোগানে পরিবর্তন আনার জন্য সৃজনশীলদের সমন্বয়ে একটি `শ্লোগান-প্রকল্প` উন্মোচন করা উচিৎ। বিশেষ করে আগুন জ্বালানোর কোনো ব্যাপার না থাকলেও, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আন্দোলনকারীরা প্রথমেই যে "জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো" বলেন; এবং মানুষের চামড়া তোলা একটা কঠিন ব্যাপার হলেও, "অমুকের চামড়া...তুলে নেব আমরা" বলতে থাকেন - এ বিষয়ে আমি বহুদিন ধরেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করছি। তাছাড়া "এ্যাকশন এ্যাকশন... ডাইরেক্ট এ্যাকশন" এই শ্লোগানটা শুনলে আমার কেমন জানি অশ্লীল মনে হয়।

সহি শ্লোগানের ভাষা কোচিং সেন্টারের নোটের মতো লিখে দিয়ে, পাখি পড়া করিয়ে দিলে, কেমন একটা বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন আন্দোলন হবে, ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে!”

সবশেষে টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট নিয়ে আমার কেন এতো গা জ্বলছে সেটাই বলি। বন্ধু হাসান মাসুদ ভ্যাটের তোয়াক্কা না করলেও আমার এটা খুব লাগছে। সন্তানের জন্য আমিও তার মতো কয়েক বছর ধরে ভ্যাট দিয়ে আসছি। সরকারের এবারের সিদ্ধান্তের কারণে সন্তানদের সঙ্গে একজন পোষ্যও ভ্যাটের আওতায় আসায় আমাকে মাসে গুণতে হবে চার হাজারের মতো। আমি একজন নিয়মিত সহি করদাতা। এমনও বছর গেছে আমি যে কর দিয়েছি আয়ের ওপর সেটা এদেশের বহু মন্ত্রী বাহাদুরও দেননি। অভিনেতা সাহেব যেটা বলেননি সেটা হচ্ছে, আমাদের স্কুলগামী সন্তানের জন্য যখন কর নির্ধারিত করা হয়েছিল তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও সেটা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তারা আন্দোলন করায় সেটা বাদ গিয়েছে। আমার সন্তানরা বয়সের কারণে রাস্তায় নামার উপযোগী হয়নি, গাড়ির গতিরোধ করেনি বলে সরকার তাদের ওপর ভ্যাট চাপিয়ে রেখেছে। এই ভ্যাটের পরিমাণ অবৈধ পথে উপার্জনকারীদের চোখে হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। সরকার আমাকে ট্যাক্স ও ভ্যাট চাপিয়ে যেভাবে নির্যাতন করছে এই পরিস্থিতিতে আমি রাস্তায় নামলে আমার শ্লোগান কি হবে? অনেক ভেবে চিন্তে ইন্টারনেট থেকে পাওয়া একটা শ্লোগানই আমার পছন্দ হয়েছে। একটি বিদেশী মেয়ে ট্যাক্স এর প্রতিবাদে রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে লেখা: “আই ডোন্ট নিড সেক্স। বিকজ দি গভর্মেণ্ট ফাকস মি এভরিডে’।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]

এইচআর/পিআর