শহর, তুমি কবে নারীবান্ধব হবে?
রাত বাড়তে থাকলে এই চেনা শহরটা মেয়েদের কাছে অচেনা হতে থাকে। শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় রাস্তায় থাকা দুর্বৃত্তরা সুযোগ হাতিয়ে নেওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। যে শহরে বড় হয়েছি ছোট্টবেলা থেকে, যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই প্রতিনিয়ত, রাত হলেই বিভীষিকাময় হয়ে উঠে আমার কাছে। আমার ছেলে বন্ধুরা ইচ্ছেমত “রাতভ্রমণ”এ বের হয়, সেখানে বাড়ির রাস্তার মোড় অবধি যেতে আমার মানা। অগত্যা ঘরে বসে চুপিচুপি গুগল স্ট্রিট ভিউ তে রাতে বসে ঢাকা শহর ঘুরে আসি। এই নিয়ে একটা লেখা ফেসবুকে দিয়েছিলাম, আমাকে একজন হুট করে মেসেজ দিল “ আপু, এইটা বাংলাদেশ, এইটা মাথায় রাইখেন”।
মাথায় রেখেই বলছি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কেরালার রাজধানী ত্রিভান্দ্রুম শহরকে নারীবান্ধব করতে দারুণ সব ব্যবস্থা করেছে। কাজের চাপে মেয়েদের ফিরতে দেরি হতে পারে অথচ হোস্টেল বন্ধ করে দেয় ৭ টায়, কিংবা নতুন শহরে কাজ খোঁজ করতে এসে যে হোটেলে উঠছে তা আদৌ নিরাপদ কিনা কে জানে ? তাই এইসব থেকে নারীদের রেহাই দিতে শহরে গড়ে উঠেছে “শর্ট স্টে হোম” । ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা, ২৮ ঘণ্টা সরকারি নিরাপত্তা! রাস্তায় নামিয়েছে “she-ট্যাক্সি”, “she-বাস” ।
২০০৭ সালে “Women Friendly City Project” হাতে নিয়েছিল কোরিয়ার রাজধানী, সিউল নগর কর্তৃপক্ষ । ফলাফল আজ সিউল হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ নারীবান্ধব শহর। রাতে নিরাপদ চলাচলের জন্য বিশেষভাবে ট্যাক্সি চালু করা হয়েছে, যাতে যাত্রী উঠলেই যাত্রীর পরিবারের সেলফোনে ক্ষুদেবার্তা চলে যায় যে সে নিরাপদে আছে। নারীদের জন্য নিজস্ব কনসার্টের ব্যবস্থা করেছে সিউল। কে না জানে, কনসার্টের হই হুল্লোড়ের মাঝে কতশত নারীকে অবাঞ্ছিত স্পর্শের শিকার হতে হয়। মায়েদেরকে কাজে উৎসাহ দিতে “মম ইজ এক্সাইটেড”, সন্তান হবার পর নারীরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তাই অত্যাধুনিক ডে কেয়ার, ক্যারিয়ার বিষয়ক বা অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ দিতে “উইমেন সিইও একাডেমি” কিংবা “হোপ কল সার্ভিস” এর মত সিউলকে নারীবান্ধব করতে ৯০ টার মত প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম বছরেই ৩০ হাজার নারী কর্মীর অংশগ্রহণ বাড়ে। আর এখন তো সিউল নারীদের বন্ধু শহর, রাতে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারে দূরপাল্লায়, পরিবারের সকলেও নিশ্চিত ঘরের মেয়েটির নিরাপত্তা নিয়ে।
ঢাকা শহর কি এইরকম হতে পারে না ? সিটি নির্বাচনের আগে ঢাকাকে নারীবান্ধব শহর করতে চায়, এমন প্রতিশ্রুতি অনেক শুনেছি। নারীদের জন্য অনেক আইন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু শহর নারীবান্ধব না হলে কোনো আইনই কাজে আসবে না, নারী সে সুবিধা নিতেই পারবে না ! কারণ আইনের আওতায় আসতে হলেও, নারীকে ঘর থেকে বের হতেই হবে! কিন্তু বের হলেই যে হিংস্র থাবা, তার থেকে কে বাঁচাবে?
এই শহরে নারীরা ইচ্ছা করলে একা থাকতে পারে না। সিউলে বা ত্রিভান্দ্রুমে থাকার ব্যয় নারীদের জন্য ইচ্ছে করেই কমিয়ে দিয়েছে। যাতে একাকী তরুণী নিশ্চিন্তে শহরে থাকতে পারে। ঢাকায় ভাবা যায় সেটা?
কত সাংস্কৃতিককর্মী যেমন মঞ্চ অভিনেত্রী, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পীকে রাতে কাজে বাইরে থাকতে হয়। পরিবার অনুমতি দেয় না বলে তাদের স্বপ্নের কাজ কে বিসর্জন দিতে হয়। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও আমাদের নারীরা এই সামান্য ঘরের বাইরের অনিরাপত্তার জন্য নিজেদের প্রতিভা বিকাশ করতে পারে না । এ দায় কার?
আমার ঐ বন্ধুটি যে বলেছিল “এটি বাংলাদেশ”, হ্যাঁ বাংলাদেশ বলেই আমরা স্বপ্ন দেখি একদিন এর শহরগুলো নারীবান্ধব হবে ; কানাডার ভিক্টোরিয়ান, অটোয়া কিংবা ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের মত। আমাকে রাতে গুগল স্ট্রিট ভিউ তে ঢাকা শহর ঘুরে আসতে হবে না মধ্যরাতে। আমি বা আমরা নির্ভয়ে রাস্তার মোড় পার হয়ে, বড় রাস্তায় হেঁটে যাব । আমাদের ভয় থাকবে না কোনো লম্পটের।। যত রাতই হোক কনসার্ট সেরে একা বাসায় আসতে পারব নির্দ্বিধায়, লাগবে না কোন পুরুষসঙ্গী। রাতে যেসব কোম্পানিতে কাজ করতে হয়, সেখানে আর লেখা থাকবে না “Only male can apply”।
আমাদের চেনা শহর ঢাকা, রাত হলেই যেন আর বদলে না যায়। আমাদের এই শহর আমাদের বন্ধু হোক। এই চাওয়াটা কি খুব বেশি কিছু?
এইচআর/এমএস