ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাখ্যান

ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার | প্রকাশিত: ০২:০০ পিএম, ০১ জুলাই ২০১৯

এই ভূখণ্ডে রবীন্দ্রবিরোধিতা নতুন নয়, পাকিস্তান আমলে শুরু, এখনও রবীন্দ্র বিদ্বেষীরা তাঁকে হিন্দু কবি হিসেবে দেখেন! তাঁর রচনাবলীর মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ, নারী বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা নানাবিধ ত্রুটি খুঁজে চলেছেন। কিছুদিন যাবৎ সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নাকি বিরোধিতা করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

প্রসঙ্গত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২১ সালে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২১ জানুয়ারি ঢাকা সফরকালে কযেকজন মুসলিম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার সঙ্গে দেখা করে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনুযোগ করেন। এই ক্ষতি পূরণের জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে লর্ড হার্ডিঞ্জ প্রতিশ্রুতি দেন।

ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু সমাজ মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বরাদ্দ কমে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।

শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। এ থেকেই অনুধাবন করা যায় যে, অধ্যাপক পদ কত সম্মান, গুরুত্বপূর্ণ ও তপস্যার ছিলো!

সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ যে শ্রেণী ধারণ করতেন তাদের কয়েকজন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে। এই ধারণা থেকে অনেকে লিখেছেন তিনিও এর বিপক্ষেই ছিলেন। সাম্প্রতিক সূত্রপাত ২০০০ সনে জেনারেল (অব.) এম এ মতিন 'আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ বইয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়”। আমি শুধু অবাক নই হতবাক হই যে এই রকম একজন সাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী ব্যক্তি তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছন! তিনি শুধু মিথ্যাচারই করেননি, তিনি ইতিহাস বিকৃতি করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ এর মতে "কেউ কেউ কোনো প্রমাণ উপস্থিত না করেই লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। ও রকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল অসম্ভব, কেননা সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ সিটি অব প্যারিস জাহাজযোগে রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার কথা ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে ওইদিন সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কলকাতায় কয়েক দিন বিশ্রাম করে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন। "

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছর' নামে বইয়ের কোথাও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় না। কাজী মোতাহার হোসেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলেনর অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনিও লেখনীতে কোথাও উল্লেখ করেননি রবীন্দ্রনাথের এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার তথ্যটি।

২০১১ সালে ২৮-২৯ জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট বার্ষিক অধিবেশনের আলোচনায় অধ্যাপক ফকরুল আলম উপস্থাপন করেন, …”রবীন্দ্রনাথ একসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিরোধী ছিলেন….কিন্তু….চারপাঁচ বছর পর তার পুরানো পজিশন পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন।….অবশ্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রহণ করেছেন বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননায় এসেছিলেন।….যারা ইতিহাসকে এক জায়গায় রেখে দেয় তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, তারা সত্যকে বিকৃত করে।….” (কার্যবিবরণী, পৃ:১৭৮)।

এটাই ধ্রুব সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেন নাই, করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেই সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হতো না। তদুপরি ১৯৩৬ সালে তাঁকে ডিলিট উপাধী প্রদানের বিষয়েও বিরোধিতা হতো বৈকি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, "যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশের গুণী জন্মাতে পারে না।" রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় জমি দানকাারী নবাব স্যার সলিমুল্লাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে প্রচার চোখে পড়ার মতো।

একজনকে বড় করতে যেয়ে আকাশসম ব্যক্তিকে মাটিতে নামানো তা নবাবেরই অপমান। কারণ ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ঢাকার নবাবের আতিথ্যলাভ করেন যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে নির্দেশ করে। অবশ্যই ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু, হঠাৎ ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু বরন করলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ঢাকার বলিয়াদির জমিদার অফুরন্ত সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই জগন্নাথ হলের নামকরণ হয়।

রবি ঠাকুর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরোধিতার কল্পকাহিনী আসলে কিছু অসুস্থ চিন্তার ধর্মান্ধ ও ইর্ষান্বিত ব্যক্তিদের অপসৃষ্টি বৈ ভিন্ন কিছু নয়। রবি ঠাকুর বাঙালির মধ্যগগনের সূর্য যার তাপ নিয়ে আমরা বার বার ঝলসে উঠি, যার আলো নিয়ে আমরা আঁধারে পথ দেখি। এই রবির কিরণ হাত দিয়ে রোধ করা যায় না তাতে হাতই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে অনিবার্য! যতই মিথ্যাচার করা হোক, বাঙালি ও বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় অম্লান থাকবেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লেখক : ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।

এইচআর/আরআইপি

আরও পড়ুন