ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘রিফিউজি’ না ‘মুসলমান’ না ‘মানুষ’?

প্রকাশিত: ০৬:১৫ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঐ সময়ে যখন মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে সাগর পাড়ি দিতে শুরু করেছিল।

ধবধবে সাদা জোব্বা পরা আরবদের চোখে বাংলাদেশের মানুষ তো ‘খাল্লিবাল্লি’, রান্নাঘর সামলাতে আর শহর-বন্দর তৈরি করতে বাংলাদেশিদের লাগে। ‘অমুসলিম’ ভারতীয়দের সাথে কেন সব সখ্য, আর মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশিদের ব্যাপারে কেন ‘কুল্লু হারামি বাঙালি’ উচ্চারিত হয় এই আরব ‘মুসলমান’-দের মুখ থেকে, খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম দুবাইতে এক পদস্থ আরবের কাছে। দরিদ্র বাংলাদেশকে ওরা সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না, আলাপে তা-ই মনে হয়েছিল আমার। অথচ, রোহিঙ্গা মুসলমানদের জায়গা দিচ্ছে না বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া যখন সুকৌশলে মুখে ফেনা তুলছিল, তখন আরবের আবেগ মাথায় উঠে যেত। আমাদেরকে তিরস্কারের সুরে শোনাতো, ‘মুসলমান’ বাংলাদেশ ‘মুসলমান’ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিচ্ছে না। বন্ধু ভারত তো মিয়ানমারের-ই প্রতিবেশি, দায় কি ওদেরও নেই?-এমন প্রশ্নে শুনেছি, ‘মুসলমান রিফিউজি’-কে সাহায্য করা ‘মুসলমান’-এর জন্য ফরজ। বেশ তো, বাংলাদেশ দুই লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছে, ভারত অন্ততঃ দুইশ’ তো পারে। বলেছিলাম, ‘মুসলমান রিফিউজি’ হোক আর ‘রিফিউজি’ হোক, মানুষ কেবল-ই মানুষ। মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে ধর্ম-বর্ণ বাধা হতে পারে না। মানবতার সত্য এ নয়।

দ্য ন্যুয়র্ক টাইমস-এর ২৮ জুন, ২০১৫-এর একটি রিপোর্টের শিরোনামই ছিল  ‘China and India are sitting out refugee crisis’  ভূমিকম্পদুর্গত নেপালে চীন-ভারত সাহায্য পাঠিয়ে প্রশংসার কাজ করেছে, কিন্তু একই সময়ে সাগর-ভাসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ভারতের প্রসঙ্গ থাক, আরব দেশগুলো কি রোহিঙ্গা মুসলমানদের জায়গা দিয়েছে? তথ্য-উপাত্ত কোনো ভাবেই সন্তষ্টি জাগাতে পারে না। মিয়ানমারের মুসলমানদের কি আরবরা দূর দেশের মুসলমান মনে করে হাত গুটিয়ে রেখেছে? হতে পারে। তাহলে ওরা নিশ্চয়ই নিজেদের ঘরের মানুষদের খুব সাহায্য করে?

সাগরে ভেসে আসা তিন বছরের শিশু আয়লানের ছোট্ট শরীরটা এই প্রশ্ন আরবদেরকেও করেছে, ওহে মুসলমান! তুমি কি মুসলমানকে সাহায্য করছ?

এর জবাবে না-বোধক উত্তরই পাওয়া যায়। আরবের ধনাঢ্য মুসলমানরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ে একদম চুপ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মুসলমানরা জীবন হাতে নিয়ে পথে নেমেছেন। একটা দেশের নাগরিক, এই পরিচয় মুছে ফেলে তারা হয়েছেন ‘রিফিউজি’। অমুসলমান জার্মানী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এই রিফিউজিদের দিকে, আর আধুনিক শহর-বন্দর গড়ে তোলা, বিশ্বের অন্যতম সেরা পার ক্যাপিটা ইনকামের আরব মুসলমানরা কিছুই করছেন না, কেন না ‘রিফিউজি’ পরিচয়ের আড়ালে ‘মুসলমান’ পরিচয়টাও তাদের চোখে পড়ছে না, ‘মানুষ’ পরিচয় তো একেবারে না। সরকার নিয়ন্ত্রিত আরবের গণমাধ্যম সিরিয়ান যুদ্ধ চোখে দেখলেও কেন যেন হাজারো সিরিয়ান মুসলিমদের ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা ও সাগরে ডুবে মরা দেখতে পাচ্ছে না।  বদনামের তোড়ে যেটুকু রিফিউজিকে জায়গা দিতে চাচ্ছে, তা বলার মত নয়। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য ‘যোদ্ধা’ পাঠাতে কাতার -সৌদি আরবের ফান্ডের অভাব নেই, আমেরিকার পকেটে রক্ষিত সিরিয়ার ‘জিহাদি’-দের সাহায্যার্থে অর্থ সাহায্য দিতে আপত্তি নেই, রিফিউজিদের সাহায্য করতে গেলে ওদের হাত-পা বাঁধা। আরব দেশগুলোর এক পক্ষ বলছেন, সব দোষ ইরান আর রাশিয়ার, কেননা তারা বাশার-কে সাহায্য করছে। আরেক পক্ষ বলছে, সিরিয়ার এ হাল করলটা কে? আমেরিকা কেন বাশারকে গদি থেকে নামাতে পারল না? যদি পারত, তাহলে তো আর এরকম হত না। নাসির আল-খলিফা নামের কাতারের এক প্রাক্তন কূটনৈতিক টুইটারে স্পষ্ট বললেন, ইউরোপের কেউ কেউ যে সাহায্য করতে চাইছে, তা নাকি ‘কুম্ভিরাশ্রু’। তাঁর মতে, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের আরো বেশি অস্ত্র জোগানো প্রয়োজন। তা না করে আমেরিকা ইরানের সাথে যে শান্তি স্থাপনে ব্যস্ত! ইউরোপ-আমেরিকার বোকামির ফল তাদের ভোগ করতে হবে, তাই রিফিউজিদের দায়ও তাদের নিতে হবে।

সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ দ্য ন্যুয়র্ক টাইমস-এর শিরোনাম এরকম- Wealthy Gulf Nations are criticised for tapid response to Syrian Refugee crisis. আকাশ-ছোঁয়া অট্টালিকা, শপিং মল, মেট্রো রেল-এর কুঝিকঝিক আরবের দেশগুলোতে, অথচ ওদেরই প্রতিবেশি সিরিয়া থেকে চল্লিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ রিফিউজি হতে বাধ্য হয়েছে। ইতালিতে পালিয়ে যাওয়া ওমর হারিরি নামের এক সিরিয়ান রিফিউজি দ্য ন্যুয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিককে বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই সিরিয়ান রিফিউজিদের দায়িত্ব নিতে পারত, কিন্তু তারা কখনোই সাড়া দেয়নি।’ ইউরোপে আশা খুঁজতে থাকা মানুষগুলোর মত ওমর হারিরিও বলেন, ‘ওরা সন্ত্রাসীদের সাহায্য করে, রিফিউজিদের নয়।’

কুয়েতের এক টিভি অনুষ্ঠানে উপস্থাপক ফাহাদ আলশেলাইমি তো বলেই দিলেন, তার দেশ রিফিউজিদের জন্য খুব ‘এক্সপেনসিভ’, কিন্তু শ্রমিকদের জন্য ‘ঠিক আছে’। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্য পরিবেশ আর জায়গা থেকে আসা কাউকে আপনি স্বাগতম জানিয়ে সমাজে ঠাঁই দিতে পারবেন না, যাদের মানসিক বা স্নায়বিক সমস্যা বা ট্রুমা আছে।’

কার্টুনিস্টরা এরকম বক্তব্য লুফে নিয়েছে। এরকম একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী আরব পোশাকের একজন কাঁটাতারের বেড়ার ভেতর থাকা বন্ধ দরজায় কাটা গর্ত থেকে মাথা আর হাত বের করে একজন রিফিউজিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকাওয়ালা পাশের দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে।  আরব লোকটা পরামর্শ দিচ্ছে, ‘এখন তাদের দরজা খোল!!’

আরেকটি কার্টুন এরকম, এক গালফ শেখ রিফিউজিভর্তি একটি নৌকার দিকে আঙ্গুল তুলে ইউরোপের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে, যদিও তার আরেক হাতের বুড়ো আঙ্গুল গনগনে আগুনে জ্বলতে থাকা সিরিয়ার বিদ্রোহীদেরকে উৎসাহ জানিয়ে থাম্বস-আপ অবস্থায়! কুয়েতের আমির এক কার্টুনে বলছেন, ‘সিরিয়ার রিফিউজিদের আমরা নিতে পারি, যদি তাদের কুয়েতি নাগরিকত্ব থাকে।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট কার্টুনে বলছেন, ‘আমরা দুবাইতে অনেক ধনী রিফিউজিদের জায়গা দিয়েছি।’

সুতরাং, ‘রিফিউজি’  না ‘মুসলমান’  না ‘মানুষ’। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের কাছে বিষয়টা এরকমই। জার্মানী আট হাজার রিফিউজিকে আশ্রয় দিতে চাচ্ছে বা এই বছরে আট লাখ রিফিউজিকে আশ্রয় দেবে বলে পুরো ইউরোপের চেহারায় মানবিকতা খুঁজতে চাওয়া বোকামি হবে। এ তো এক দিনের বিষয় নয়, রিফিউজি-দেরকে মানুষের জীবন যাপন করতে দিতে হলে অনেক কিছু করতে পারার মানসিকতা ইউরোপের আছে কি না, তা দেখতে হলে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।

ততদিন, হে শিশু আয়লানের আত্মা, তুমি আকাশ থেকে কেবল-ই  ‘রিফিউজি’ দেখতে থাক।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক
[email protected]

এইচআর/আরআইপি