ঐতিহ্য চাই, তার আগে চাই নিরাপদ পুরান ঢাকা
এখন আমরা যে ঢাকাকে চিনি, সেটা কিন্তু নকল ঢাকা। আসল ঢাকা পুরান ঢাকা। খাঁটি ঢাকা খাঁটি বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। বুড়িগঙ্গা থেকে উত্তরে ৮/১০ কিলোমিটার, পূর্বে-পশ্চিমে আরো ৮/১০ কিলোমিটার- এই হলো ঢাকা। দক্ষিণে সদরঘাট, উত্তরা ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন- এই হলো ঢাকার সীমানা। বড় জোর সে সীমানা ঢাকা গেট পর্যন্ত। এই ঢাকা গেট ঢাকার শেষ প্রান্ত।
এখন সেই ঢাকা গেট খুঁজে বের করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে গেলে তিন নেতার মাজার পেরিয়ে দেখবেন গাছপালার আড়ালে দুটি ছোট্ট স্থাপনা। এই ঢাকা গেট একসময় ঢাকার উত্তর প্রান্ত ছিল। এখন নকল ঢাকার কেউ কেউ একে দক্ষিণ সীমানা বানিয়ে ফেলতে চান। এর দক্ষিণে যে পরিত্যক্তপ্রায় আসল ঢাকা আছে, সেদিকে যেতেই চান না নকল ঢাকার মানুষেরা।
বলছিলাম ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। কিন্তু আজ সেই বুড়িগঙ্গাও মৃতপ্রায়, ঢাকারও একই দশা। ঢাকা মানে আসল ঢাকা, এখন আমরা যেটা অবহেলা করে পুরান ঢাকা বলি। কিন্তু এই পুরান ঢাকাই কিন্তু আমাদের ঢাকার ঐতিহ্য। চারশ বছরের পুরোনো এই শহরের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। কিন্তু এই পুরান ঢাকা এখন আর বাসযোগ্য নয়। অনেক মানুষ থাকেন বটে, কিন্তু পুরান ঢাকা সত্যি সত্যি বাসযোগ্য নয়। নিমতলী ও চকবাজারের আগুনের পর এটি আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই।
বাসযোগ্যতার প্রথম শর্ত হলো, নিরাপত্তা। সেই নিরাপত্তাই নেই পুরান ঢাকায়। ট্র্যাজেডি হলো, যে ঢাকার যে অংশটি বাসযোগ্যই নয়, সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকার একটি। তার মানে আমরা জেনেশুনে লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুকূপে থাকতে দিচ্ছি।
নিমতলী আর চকবাজার আমাদের জাগানোর, শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমরা জাগিওনি, শিখিওনি। দুটি আগুন তো ওয়ার্নিং দিল, একটা বড় ভূমিকম্পে কী হবে পুরান ঢাকার, ভাবতেও ভয় লাগে। এখন প্রশ্ন হলো, এই পুরান ঢাকা নিয়ে আমরা কী করবো? এ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, তর্ক হচ্ছে; কিন্তু কোনো গ্রহণযোগ্য বাস্তব সমাধান আসেনি।
একসময় যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে নদীর তীরেই গড়ে উঠতো বসতি। বুড়িগঙ্গার তীরে তাই গড়ে ওঠে ঢাকা। পূর্ববঙ্গের কেন্দ্রে অবস্থান হওয়ায় ঢাকা দ্রুত বাড়ে। মোগলরা এসে ঢাকার মর্যাদা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। শত বছরের পথপরিক্রমায় ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। দক্ষিণে সদরঘাট আর উত্তরের সীমা ছাড়াচ্ছে উত্তরা। পূর্বে গড়ে উঠছে পূর্বাচল, পশ্চিমের সীমা আপাতত বেড়িবাঁধ। তবে নিকট ভবিষ্যতে চারদিকেই ঢাকা আরো বাড়বে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা অপরিকল্পিত নগরায়ণ। আমরা অগ্নি নিরাপত্তা, পানি নিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ভূমিকম্প ঝুঁকির কথা না ভেবেই একের পর এক ভবন বানাচ্ছি। নতুন ঢাকার যেমন ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী; একসময় পুরান ঢাকারও তেমন ছিল ওয়ারী। কিন্তু আমরা চোখের সামনে আবাসিক এলাকা ধানমন্ডিকে বাণিজ্যিক এলাকা বানিয়ে ফেলছি। এখন পুরান ঢাকার যে অবস্থা, দুইশ বছর পর নতুন ঢাকারও একই দশাই হবে।
বলছিলাম ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা অপরিকল্পিত নগরায়ণ। কিন্তু পুরান ঢাকার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। পরিকল্পনা থাকলে তো অপরিকল্পনার প্রশ্ন। পুরান ঢাকায় যা হয়েছে তা স্রেফ স্বেচ্ছাচারিতা, রীতিমত অপরাধ। চারশ বছর বা তিনশ বছর বা শতবছর আগে যা হয়েছে, তা বিবেচনার বাইরেই থাক। গত ৫০ বছরে যা হয়েছে, তার দায়িত্ব কিন্তু রাজউককেই নিতে হবে। পুরান ঢাকায় কি রাজউকের নিয়ম প্রযোজ্য নয়? সেখানে কি বাড়ি করার আগে অনুমতি লাগে না, জায়গা ছাড়তে হয় না? সেখানে বিদ্যুতের তার টানার কোনো নিয়ম নেই? রাস্তার কি কোনো মাপ নেই?
পুরান ঢাকায় কিভাবে গায়ে গা লাগিয়ে ভবন উঠে যায়? পাশাপাশি দুটি গাড়ি চলতে পারে এবং পথচারীরা নিরাপদে হাঁটতে পারে, রাস্তা বলতে হলে অন্তত এটুকু থাকতে হবে। চুড়িহাট্টার আগুনে বেমিরভাগ মানুষ কিন্তু মারা গেছে খোলা আকাশের নিচে। এমন গিট্টু জ্যাম লেগেছিল যে, মানুষ দৌড়েও নিরাপদস্খানে যেতে পারেনি। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মত জায়গাও সেখানে নেই। অথচ পাঁচ রাস্তার মোড় এই ব্যস্ত চুড়িহাট্টা।
পুরান ঢাকায় অসংখ্য 'মাস্তান গলি' আছে। এসব গলিতে দুইপাশ দিয়ে গাড়ি ঢুকলে যাওয়ার পথ থাকে না। তখন যিনি মাস্তান, তিনি আগে যান, নিরীহ মানুষকে পিছিয়ে যেতে হয়। প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকার সরু গলি প্রশস্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ। তবে এক্ষুণি যেটা করতে হবে, সেটা হলো যে রাস্তা কমপক্ষে ২৫ ফুট চওড়া, সেটি দুইদিকের গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। যেটি অন্তত ১৫ ফুট চওড়া, সে রাস্তায় একমুখী চলাচল হবে। ১০ ফুট হলে শুধু একমুখী রিকশা চলবে। এরচেয়ে সরু হলে, সেটি শুধু পায়ে চলার জন্য ব্যবহৃত হবে, কোনো যানবাহন চলবে না।
সব রাস্তায় উন্মুক্ত ফুটপাত থাকতে হবে। আর যেসব এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার জায়গা সেই, সেসব এলাকায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট বসাতে হবে। পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকাকে ফায়ার হাইড্র্যান্টের আওতায় আনতে হবে। সে হাইড্র্যান্টে থাকবে ওয়াসার পানির সংযোগ। যাতে পানির অভাবে আগুন নেভানোর কাজ বিঘ্নিত না হয়। আর গাড়ি যেতে না পারলেও শুধু পাইপ নিয়ে হাইড্র্যান্টে সংযোগ দিয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে পারে। আর অনতিবিলম্বে ঘনবসতি এলাকা থেকে সকল বিপদজনক কেমিক্যালের কারখানা ও গোডাউন সরাতে হবে।
এসবই স্বল্পমেয়াদী সমাধান। পুরান ঢাকাকে বাঁচাতে হলে চাই দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত পরিকল্পনা। পুরান ঢাকাকে একেবারে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, বাস্তবসম্মত নয়; উচিতও নয়। তবে ইদানীং ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি এই পরিকল্পনার সাথে আংশিকভাবে একমত। তবে প্রথম কথা হলো, পুরান ঢাকাকে বোঝা নয়, সস্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
অনেক শহরেরই এমন ঐতিহ্য নেই। তাই প্রথমে ঐতিহ্য রক্ষার কখা ভাবতে হবে। আমি মালয়েশিয়ার মালাক্কা, ভারতের জয়পুরের পিঙ্ক সিটি দেখেছি। ছোট আকারে বাংলাদেশে সোনারগাওয়োর পানামনগর আছে। তাই পুরান ঢাকার কিছু অংশ চিহ্নিত করতে হবে। যেমন শাখারিবাজার, ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার, ইসলামপুর। এসব এলাকার বাসিন্দাদের পুনর্বাসন করে পর্যটন এলাকা বানাতে হবে। সেখানে পর্যটকদের জন্য হেরিটেজ হোটেল বানানো যেতে পারে। সেটা হতে পারে কোনো ঐতিহ্যবাহী ভবনে, যেমন রূপলাল হাউস।
অন্য এলাকার ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণ করেই ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্ট বা ভূমি পুনঃউন্নয়ন পরিকল্পনা বান্তবায়ন করতে হবে। এ পরিকল্পনায় পুরান ঢাকার ছোট ছোট প্লটকে একত্র করে ব্লকভিত্তিক আবাসন গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। সত্যি কথা হলো, ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্ট ছাড়া পুরান ঢাকাকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। সিঙ্গাপুর, চীন, জাপানসহ অনেক দেশেই এই পদ্ধতিতে শহর পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
এই পদ্ধতিতে ছোট ছোট প্লট একত্র করে বড় আকারে পরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা হয়। উচু আবাসন গড়ার পাশাপাশি সেখানে জলাশয়, রাস্তা, স্কুল, পার্ক, মসজিদ রাখা হয়। আর জমির মালিকরা আনুপাতিক হারে ফ্ল্যাট পাবেন। বংশাল এলাকায় এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে রাজউক কাজ শুরু করলেও এলাকাবাসীর আপত্তির কারণে এগুতে পারেনি।
এলাকাবাসী রাজউকের ওপর আস্খা রাখতে পারেনি। তবে আসল সমস্যা হলো পুরান ঢাকার মানুস বংশ পরম্পরায় সেখানে থাকেন। যাদের অনেকেরই জমিতে দখল থাকলেও কাগজপত্র ঠিক নেই। যাদের কাগজ ঠিক নেই, তারাই রাজউকের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তবে এই সমস্যার সমাধান করে হলেও ভূমি পুনঃউন্নয়নের দিকেই যেতে হবে।
তবে পুনঃউন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যকে মাথায় রাখতে হবে। ঐতিহ্য বিলীন করে উন্নয়নের ভাবা আত্মধ্বংসের শামিল। ঐতিহ্য অবশ্যই চাই, তবে তার আগে চাই নিরাপদ পুরান ঢাকা। ঐতিহ্য আর উন্নয়ন যেন হাত ধরাধরি করে হাঁটে। পুরান ঢাকার পথে পথে যেন আমরা পাই ইতিহাসের সন্ধান। আবার তা যেন হয় নিরাপদ।
এইচআর/আরআইপি