খতম করো, জেতো আর খাও ভার্চুয়াল ‘চিকেন ডিনার’
ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কত ধরনের সুবিধা যে বেড়েছে— তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যোগাযোগ থেকে শুরু কেনাকাটা, ব্যবসা-বাণিজ্য, খাবার সাপ্লাই কি নেই এই ইন্টারনেটের দুনিয়ায়! এসব ভালোর সাথে এখন যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের অশ্লীল সাইট, গেমিং অপশন, ডেটিং সাইট আরো যে কত কী!
শিক্ষকতা পেশায় থাকার সুবাদে তরুণদের সাথে মেশার যে সুযোগ পাই সে সুযোগে তাদের কাছ থেকে তাই সহজেই জানতে পাই ইন্টারনেট দুনিয়ার ক্ষতিকর এ দিকসমূহ সম্পর্কে। আর সেসব শোনার পরে ভীষণরকমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি ।
আজকের তরুণ প্রজন্মের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। হতাশা, উত্তেজনা বা একাকীত্ব তাদেরকে গ্রাস করছে। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সামাজিক বন্ধনগুলো কেমন যেন আলগা হয়ে পড়ছে। ইন্টারনেটের অপ্রতুল সময়ে আমরা যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছি সে সময়ে আমরা দলবেঁধে এক সাথে খেলাধুলা করতাম, ঘুরতে যেতাম।ছুটির দিনগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল, ক্রিকেটসহ হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলতাম। শহরের ছেলেমেয়েরাও ফুটবল, ক্রিকেট খেলতো।
যদিও তাদের খেলাধুলার সুযোগ হয়তো সীমিতই ছিল। তবুও ধারণা করি ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের হুহু বাতাস আসার আগে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলায় শহুরে ছেলে-মেয়েদেরও আগ্রহ তীব্রই ছিল। কিন্তু এখন?ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের দুনিয়ায় বাস্তবের “গেম” বা খেলাধুলা ঠাঁই নিয়েছে মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে।
ফলে ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের ভালোর সাথে সাথে আজকের তরুণ প্রজন্ম এ বিষে নীলও হচ্ছে। খেলাধুলা হয়ে গেছে কি-বোর্ড কেন্দ্রিক। আপাতভাবে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো দৃশ্যমান তরুণ প্রজন্ম একসাথে থেকেও যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। একসাথে থেকেও তারা ব্যস্ত থাকে ইন্টারনেট বা অন্তর্জালের জগতে। ফলে কাছে থেকেও তারা যেন হয়ে ওঠে আলাদা আলাদা সময়ের বাসিন্দা। একসাথে মিলে নিছক আড্ডাবাজি বা কোনো সৃষ্টিশীল কাজ নয়; তারা খেলছে সর্বনাশ নানা অনলাইন গেম।
সবার নিশ্চয়ই মনে অছে, ২০১৭ সালে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের স্কুল পড়ুয়া মেধাবী এক কিশোরীর আত্মহত্যার পর প্রথম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে ইন্টারনেটভিত্তিক গেম বা খেলার জগতের কথা। ইন্টারনেটভিত্তিক সে গেমের নাম ছিলো 'ব্লু হোয়েল' ।
দেখা গেছে, এটি এমন একটি গেম যেখানে ঢোকা যায়, কিন্তু সহজে বের হওয়া যায় না । এ গেমের ৫০ তম ধাপে এসে তাই দেখা যায় গেমার আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আর এখন শুনছি পাবজি (PUBG-Player Unknown Battle Ground), ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স, মর্ডার্ন স্ট্রাইক অনলাইন, মর্ডার্ন কমব্যাট-৫, কাউন্টার স্ট্রাইক, ফায়ারফ্লাই সহ অঅরো অনেক গেম। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গেম হচ্ছে পাবজি (PUBG-PLAYERUNKNOWNS BATTLEGROUNDS)। তারপর হচ্ছে ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স।
ইন্টারনেটভিত্তিক এ গেম দুটো খেলতে হয় দলবেঁধে। অর্থাৎ একই সাথে অনেকে নেটে উপস্থিত থেকে দুনিয়ার যে কোন প্রান্ত থেকেই তা খেলতে পারে। সবচেয়ে জনপ্রিয় পাবজি (PUBG-Player Unknown Battle Ground) তে মোট ১০০ জন প্লেয়ার থাকে। প্রতি গ্রুপে ৪ জন করে মোট ২৫ টি গ্রুপ এখানে অংশ নেয়। আর প্রতিটি গ্রুপের কাজ হচ্ছে অন্য গ্রুপকে খতম করা। একটা টানটান উত্তেজনা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম মেতে ওঠে এক অন্য গ্রুপকে ধ্বংস বা খতম করতে।
খতমের মধ্যেই এখানে জয় নির্ধারিত হয়। সবশেষ যে গ্রুপ জয়ী হয় তাদের জন্য থাকে ভার্চুয়াল ‘চিকেন ডিনার’। যারা হেরে যায় তাদের মধ্যে খতম করার বাসনা তীব্র হয়ে ওঠে। জেতার এক অদম্য আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। খাওয়া-ঘুম বাদ দিয়ে তাই চলতে থাকে নিরবচ্ছিন্ন এ খেলা। ফলে পড়াশুনা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে গেমিং এ আসক্ত তরুণেরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। মাথায় সবসময় ঘুরতে থাকে জেতার চিন্তা। গেমিং ভাবনা।
আর ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান্স নামক গেমিং ও অন্যের জায়গা দখলের প্রতিযোগিতায় নামে। অন্যের জিনিস লুটতরাজি করতেও হয় গেমিং এর নানা ধাপে। এখানে কমপক্ষে ১০ জন করে একটা গ্রুপ থাকে। জিতলে অপরিসীম আনন্দ। হারলে নিজের উপর নিজেরই ক্ষোভ তৈরি হয়। যতক্ষন না জিততে পারে ততক্ষন অবধি এরা শান্তি পায় না।
তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই যে, ইন্টারনেটভিত্তিক এসব গেম তরুণ প্রজন্মকে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলছে। তার ভেতরে হতাশা তৈরি করছে। অথবা খতম করার মাধ্যমে জেতার এক পৈশাচিক মানসিক অনুভূতি তৈরি করছে। ঘুম, খাওয়া বাদ দিয়ে তাদেরকে খেলায় আসক্ত করে তুলছে। তাদের পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। মাদকের চেয়ে এ আসক্তি তাই কোনো অংশেই কম কীসে?
সরকার নানা কারণে অতি সম্প্রতি বেশ ভালো সংখ্যায় পর্নসাইটসহ আরো অনেক ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এটা শুভ উদ্যোগ। এখন মনে হয় তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পর্নসাইটসহ বন্ধ করে দেয়া আরো অনেক ওয়েবসাইটের মতো গেমিং সাইটগুলোও অতি সত্ত্বর বন্ধ করে দেয়া উচিত।
সেই সাথে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের জন্য খেলাধুলা এবং শরীরচর্চার সুযোগসৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করা। না হলে মাদকের মতো অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এর জন্যও আমাদেরকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/আরআইপি