জামায়াত: প্রশ্ন ও পরিণতি
বিএনপি কেন জামায়াত ছাড়ে না বা ছাড়তে পারে না তার অনেক ব্যাখ্যা আছে। তবে এবার বিএনপি নয়, জামায়াতের লোকেরাই জামায়াত ছাড়ছেন। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ও অন্যান্য দণ্ড কার্যকর হবার পর থেকে দলটি যে ভয়াবহ সংকটে পড়েছিল, তাতে সম্ভবত শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে নেতাদের দলত্যাগের বিষয়টি।
এই দলত্যাগের কারণে হিসেবে তারা যেটি বলছেন সেটিও খুব উল্লেখ করার মতো যে, তারা মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য জামায়াতের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল এবং এখন এই নামে আর জামায়াতের কার্যক্রম চালানো সমীচীন নয়।
পাকিস্তান মুসলিম লীগ যেমন পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানও সেভাবে পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ শব্দটি আগে জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী হয়েছে। তাতে চরিত্র ও আদর্শে কোনো তফাৎ হয়নি। বেড়ালের নাম ডগ হলেও সে বেড়ালই থাকে।
জামায়াতের জন্য পাকিস্তান হয়তো আদর্শ রাষ্ট্র ছিল। কারণ সাংবিধানিকভাব পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র। ফলে জামায়াতের আদর্শ বাস্তবায়ন সে দেশে সহজ। কিন্তু বাংলাদেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র নয়। বরং সাংবিধানিকভাবে এটি পিপলস রিপাবলিক মানে, গণপ্রজাতান্ত্রিক।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে জামায়াতের ধারণাটি আকাশে বাতাসে থাকলেও এর কোনো সংগঠন ছিল না। জামায়াতের সংগঠন সৃষ্টি হয় মূলত পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পরে (মুসলিম মধ্যবিত্তের রাজনীতি, বদিউজজামান, পৃষ্ঠা ১২৯)।
সঙ্গত কারণেই এখানে জামায়াতের বিকশিত হওয়াটা বেশ কঠিন ছিল এবং এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পঁচাত্তর পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সরকার ও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠাপোষকতা ও সাহচর্য না পেলে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কস্মিনকালেও রাজনৈতিকভাবে বড় কোনো শক্তি হিসেবে বিকশিত হতে পারত না।
বরং তাকে মুসলিম লীগের মতো অতি সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং গুরুত্বহীন একটি দল হিসেবেই কোনোমতে টিকে থাকতে হতো। কিন্তু ধর্ম ও ভারতবিরোধী রাজনীতি যেহেতু বরাবরই এখানে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই বিষয়গুলো বেশ ক্রিয়াশীল, ফলে ধর্ম ও ভারতবিরোধী রাজনীতির প্রচারক জামায়াতে ইসলামীকে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দল ভারী করা এবং পরবর্তীকালে বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দলকে মোকাবেলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করলে জামায়াত অধিকতর শক্তিশালী হবার সুযোগ পায়।
অথচ শুরু থেকেই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী এই দলটিকে প্রশ্রয় না দিতো, এমনকি এরশাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনেও এই দলটিকে তারা সঙ্গে না নিতো, জামায়াত রাজনৈতিকভাবেই একটি প্রান্তিক দলে পরিণত হয়ে যেতো এবং এ জন্য এখন এত কথাবার্তার প্রয়োজন পড়ত না। অর্থাৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হতে গিয়ে জামায়াত একদিকে যেমন তাদের সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে, তেমনি বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলকে তার গ্রিপের ভেতরে রাখতে পেরেছে শুধুমাত্র মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলার কৌশল হিসেবে।
এখন বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক পরস্পরনির্ভরশীল। বিএনপি যতই দাবি করুক যে জামায়াতের সাথে তাদের কোনো আদর্শিক জোট নেই, বরং এটি নির্বাচিন জোট— সেটি ধোপে টেকে না। কারণ আদর্শিক মিল ছাড়া নির্বাচনী জোট হয় কি না, সেটিও রাজনীতিবিদ্যার একটি বড় তর্কের বিষয়।
একটি জাতির সবচেয়ে অর্জন তার স্বাধিকার আন্দোলন। এই উপমহাদেশে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যাকে স্বাধীন হতে গিয়ে তিরিশ লক্ষ্য মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য এই অঞ্চলে আর কোন জাতিকে এত রক্ত দিতে হয়নি। সেই অর্জনের পথে রাজনৈতিকভাবে যে দলটি অন্তরায় তৈরি করেছিল, সেই দলটি যে পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে একটি বড় শক্ত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারলো, সেটি একদিকে যেমন পুরো জাতির জন্য লজ্জার, তেমনি এর দায়ভার দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও এড়াতে পারে না।
তবে আওয়ামী লীগ সেই দায় কিছুটা মোচনের চেষ্টা করছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের দণ্ড কার্যকর এবং তাদের মালিকানাধীন আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের মধ্য দিয়ে দলটি বস্তুত এখন কোণঠাসা।
ভেতরে ভেতরে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চললেও তাদের শক্তি মূলত ক্ষয় হয়েছে দুইভাবে; ১. আর্থিক অবস্থা ভেঙে যাওয়ায় তাদের সাংগঠনিক অবস্থা যথেষ্ট নাজুক এবং ২. যুদ্ধাপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি জনসমর্থনে ভাটা। এখন দলের হার্ডকোর লোক ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে জামায়াতের সমর্থক খুঁজে পাওয়া কঠিন। এমনকি যারা মনে মনে সমর্থন করেন বা সুযোগ পেলে জামায়াতকে ভোট দেন, তারও সামাজিক কারণে এ কথা স্বীকার করেন না। আর প্রকাশ্য জনসমর্থন না থাকলে অনেক বড় রাজনৈতিক দলও ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে।
জামায়াতে যেভাবে এখন নেতাদের দল ত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটি আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে তাকে মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে যে প্রশ্নটি এখন ঘুরেফিরে আসছে তা হলো— জামায়াত এই প্রান্তিক অবস্থায় এসে যদি একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়ও তাহলেই তার সব অপরাধ মাফ হয়ে যাবে কি না, অর্থাৎ তাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে কি না? কারণ খুন করার পরেও একজন অপরাধী আদালতে গিয়ে বলতে পারেন যে, আমি খুন করেছি এবং ক্ষমা চাই; তাতে কি আদালত তাকে খালাস দিয়ে দেন?
যদি তাই হতো তাহলে সবাই খুন করে আদালতে গিয়ে মাফ চেয়ে বেরিয়ে আসতেন। সুতরাং একাত্তরে জামায়াত দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে তার জন্য সে যদি ৪৮ বছর পরে এসে ক্ষমা চায়ও, তারপরও তাকে ক্ষমা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে ক্ষমা চাওয়ার কাজটি তারা স্বাধীনতার পরপর করলে হয়তো তার একরকম ডাইমেনশন থাকতো। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কাছাকাছি এসে, নানারকম চাপে পড়ে এবং অস্তিত্ব বাঁচানোর স্বার্থে তারা যদি ক্ষমা চাওয়ার কৌশল গ্রহণও করে, সেটাকে আপাতত একটি ফাঁদ হিসেবেই বিবেচনা করা শ্রেয়।
অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তির অপরাধের যেমন বিচার হয়েছে, তেমনি দল হিসেবেও জামায়াতের বিচার হতে হবে। সেই বিচারের প্রক্রিয়া ও রায় কী হবে, সেটি একেবারেই আদালতের বিষয়। কিন্তু জনগণের তরফে এই দাবিটি জারি রাখা জরুরি। তবে এও ঠিক, এতদিন পরে এসে জামায়াত যদি একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়, সেটিও বাংলাদেশের মানুষের জন্য আরেকটি বিজয় বলে বিবেচিত হবে। তবে বাস্তবতা হলো, জামায়াত এই কাজটি কখনোই করবে বলে মনে হয় না। কারণ এখনও দলের ভেতরে কট্টরপন্থি লোকেরাই নীতি নির্ধারণ করেন।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/আরআইপি