সম্পাদক পরিষদ ও ৫৭ ধারা
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহারের যে অবাধ সুযোগ রয়েছে সেটি আমাদের সম্পাদকদের বুঝতে প্রায় দুবছর লেগে গেল। গত ২৪ আগস্ট এদেশের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকদের নিয়ে গঠিত সম্পাদক পরিষদ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১ ও ২) ধারা অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছে। তারা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী।
এর আগে সম্পাদকরা বৈঠকে বসে সবাই আইনের ওই ধারা বাতিলের ব্যাপারে একমত হন। ৫৭ ধারায় বলা আছে ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ’।
এই আইনে অপরাধ করলে ৭ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল এবং অনধিক এক কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে। আইসিটি আইনটি করা হয় ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার আগে। এরপর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আইনটির সংশোধন করে সাজার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এবং কিছু কিছু ধারা অজামিনযোগ্য বলে বিধান করে।
যে আইনটির বয়স প্রায় ১০ বছর হতে চলল সেই আইনটি যে অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে তা এতদিন আমাদের সম্পাদকরা বুঝতে পারেননি! ওই ধারাটি পড়লেইতো বোঝা যায় এটা সাংবাদিকদের জন্য কতোটা অনিরাপদ? এই ধারায় এর আগে কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছিল। তারা সাংবাদিক নন বলে সম্পাদকদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে থাকবে আর সম্পাদকরা চুপ থাকবেন? তারা যুক্তি দিতে পারেন আইনটি অপব্যবহার না হলে এর বিরুদ্ধে বলার সুযোগ কোথায়? কিন্তু বিজ্ঞ সম্পাদকদের মনে কী একবারও প্রশ্ন জাগেনি যে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের মতো একটি দেশে অহরহ মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে সেখানে ওইরকম একটি কালো বিধি-বিধান সময় সুযোগমতো সরকার কাজে লাগাবে। এমনতো নয় যে তারা ওই আইনটির কথা জানতেন না।
দেশের কিছু মানবাধিকার সংস্থা, কয়েকজন ব্লগার এবং কোন কোন সাংবাদিক বিক্ষিপ্তভাবে ওই ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কোনদিনই সম্পাদকরা ওই ধারার বিরুদ্ধে কলম ধরেননি। বিবৃতিও দেননি। আজ যখন একজন সাংবাদিককে ওই ধারায় আটক করা হলো তখনও তারা চুপ ছিলেন। আটকের ও মুক্তির সপ্তাহখানেক পর তাদের বোধোদয় হলো আইসিটি আইনের ওই ধারাটি অপব্যবহার হতে পারে। বিষয়টি একজন খুনিকে বন্দুকের লাইসেন্স দেয়ার সাথে তুলনা করা যায়। কোন খুনিকে যখন সরকার বন্দুকের লাইসেন্স দিবে তখন আমরা সবাই চুপ থাকব। ওই খুনি যখন ওই বন্দুক দিয়ে আবারো কাউকে খুন করবে তখন আমরা প্রতিবাদ করে বলব তাকে লাইসেন্স দেয়া ঠিক হয়নি।
সম্পাদক পরিষদ সংগঠনটা কী তা অনেকেই হয়তো জানেন না। কারণ এদেশে সাংবাদিকদের যতো সংগঠন তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নেই। তাই হয়তো এই সংগঠনটি সম্পর্কে আলাদা করে অনেকেই জানেন না। সম্পাদকদের মতো বড় পদগুলোতে যারা আছেন তাদের সর্বশেষ সংগঠন হলো এই সম্পাদক পরিষদ। এটি গঠন করা হয়েছে ২০১৩ সালে। এর আগে বিএসপি অর্থাৎ বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ ছিল মালিকদের সংগঠন যা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর গঠন করা হয় নোয়াব অর্থাৎ সংবাদপত্র মালিক সমিতি। তারাই সরকারসহ বিভিন্ন মহলে দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধিত্ব করতো। ২০১৩ সালে এসে সম্পাদকরা উপলব্ধি করলেন তাদের নিজস্ব কোন ফোরাম নেই। সবই মালিক অথবা সাংবাদিকদের সংগঠন। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফোরামের জন্য ওই সংগঠনের জন্ম। জন্মের সময় তারা বলেছিল সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন, সাংবাদিকতার পেশাগত মানোন্নয়ন ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদ নামে একটি সংগঠন করা হয়েছে।
এই সংগঠনটির জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেখলাম না সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়নে কোন ভূমিকা রেখেছেন তারা। কালেভদ্রে দুই একটি বিবৃতি দিয়েই তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করাই তাদের কাজ মনে হচ্ছে। অথচ এদেশে সংবাদপত্র জগতে এরচে’ শক্তিশালী আর কোন সংগঠন নেই। দেশের প্রায় সকল সম্পাদকই এই সংগঠনের সদস্য।
তারা প্রথমে আলোচনায় আসে গত ফেব্রুয়ারিতে। যখন বিএনপি সারাদেশে আন্দোলনের নামে ‘পেট্রল বোমা উৎসব’ পালন করছে। তখন এই সংগঠনটি বলেছিল সরকার সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা করছে। `সরকার ও প্রশাসন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনায় বাধা সৃষ্টি করছে। কখনো কখনো কোনো কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনকে অন্যায়ভাবে বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে তকমা দেওয়া হচ্ছে।’ ওই বিবৃতি নিয়ে অবশ্য সংগঠনটির সভাপতিসহ অনেকেই আপত্তি করেছিলেন। সরকারের তরফ থেকেও সম্পাদকদের উদ্বেগ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
এর আগে সম্পাদকরা ইনকিলাবের সাংবাদিককে আটক ও তার আগে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটকের প্রতিবাদ করেছিলেন। মাহমুদুর রহমান যতটা না সাংবাদিক ততটাই রাজনীতিবিদ। আর তিনি সাংবাদিকতার নামে যা লিখে যাচ্ছিলেন তা সম্পূর্ণই সাংবাদিকতার নীতি-বিরুদ্ধ। কিন্তু সম্পাদকরা কখনোই অপসাংবাদিকতার নিন্দা করেননি। সাংবাদিকতার নামে যাচ্ছে-তাই করবেন আর কলম আছে বলেই যাচ্ছে-তাই লিখবেন- এই রীতির বিরুদ্ধে সম্পাদকরা কোন কথা বলেন না। তারা বলেছেন মাহমুদুদর রহমানকে আটকের প্রক্রিয়াটি সঠিক ছিল না। তাই নিন্দা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। সম্পাদকরা যদি এতটাই মানবাধিকারপন্থি হন তাহলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বিএনপি সমর্থিত অংশটির সভাপতি শওকত মাহমুদের গ্রেপ্তারের নিন্দা ও প্রতিবাদ কেন করলেন না? কারণ তিনি সাংবাদিক হিসেবে আটক হননি? তাকে বোমা হামলা মামলায় গ্রেপ্তার করাটি কী সঠিক হয়েছে?
এখানে বলে রাখা ভালো বাংলাদেশে যে কেউই সম্পাদক হতে পারেন। যদিও ১৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়, কিন্তু কার্যত ১৫ বছরের চাঁদাবাজির অভিজ্ঞতা দিয়েও সম্পাদক হওয়া যায়। একজন সম্পাদক অস্ত্র মামলায় তিন মাসের বেশি রিমান্ডে ছিলেন, তিনি এখনো কারাগারে আছেন। সম্পাদক পরিষদ তাকে নিয়ে কোন কথা বলেন না। কারণ তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ঝুলছে। কিন্তু তিনি কী করে সম্পাদক হলেন সেই প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন না কেন? সম্পাদক পরিষদ সম্পাদকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা আরোপের বিষয়ে সব সময় দেখি চুপ থাকে? এতে কী থলের বিড়াল বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তারা!
প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্পাদক পরিষদ এখন পর্যন্ত যতো বিবৃতি দিয়েছে তাতে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, দেশের আর ১০টি পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের মতো এই সংগঠনটিও রাজনৈতিক দিক দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি ওখানেই। সম্পাদকরাও যদি রাজনীতির হালুয়া রুটির ভাগাভাগির জন্য নিজেরা বিভক্ত হয়ে পড়েন তাহলে এদেশের সাংবাদিকতার এখন যে পৌনে বারটা বেজে চলছে সেটি ১২ টা হতে ১৫ মিনিট সময়ও হাতে পাওয়া যাবে না।
এইচআর/এমএস