বলতে চাই, বিপদ চাই না
হনুলুলুর ছেলেটার সঙ্গে প্রতি সকালে ভাব বিনিময় হয় ভুরুঙ্গামারির মেয়েটির। এটা এই সময়ে কোনো চমৎকার বিষয় নয়। আজ থেকে বিশ বছর আগে এই ঘটনা হয়তো বিস্ময়ের ভাঁজ ফেলতো অনেকের কপালে। এখন সবাই বলবে এ আর এমন কী। এই তো অহরহ হয়। চট্টগ্রাম থেকে এখন ঢাকার দূরত্ব যতটুকু, লন্ডন কিংবা কায়রো কিংবা অন্টারিওর দূরত্ব ঠিক ততটুকু। প্রিয়জনকে, চাইলে দেখা যায়, কথা বলা যায়, কেবল জড়িয়ে ধরা যায় না পরম মমতায়। এসবই সম্ভব করেছে অনলাইন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যমের ভালো দিক আছে। খারাপ দিকও আছে। অনেকটা ছুরির মতো, ডাকাতের হাতে থাকলে মানুষ মরে, ডাক্তারের হাতে থাকলে বাঁচে।
বাংলাদেশে এক সময় অনলাইনের পর্ণোসাইটের ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। যৌবনজ্বালা ডট কম এক সময় অনেক ভিজিটর টানতো। সেখানে নিক নেম বা বেনামে বিচরণ করতো প্রায় সবাই। পরে সামহোয়্যার ইন ব্লগ ডট নেট এসে নতুন এক চর্চায় মাতিয়ে দেয় তরুণদের। নিজের নামে নিজের কথা জানানোর এক সুবর্ণ সুযোগ আসে সবার সামনে। তাৎক্ষণিক ভালোলাগা মন্দলাগা জানা, অনলাইনে বসবাস করার মানসিকতা তৈরি করে বিশাল সংখ্যায় তরুণদের মাঝে। তবে থেকে যায় নিক নেম, বিপুল সংখ্যায়। থেকে যায়, নিজেকে আড়ালে রেখে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সুযোগ। নিজেকে অপরিচিত রেখে নিজের মতের সঙ্গে অন্যকে পরিচিত করানোর সুযোগ। এর কিছু খারাপ দিক আছে। নিজের মতের সঙ্গে না মিললে গালাগালি করা, অপমান করার অনেক নজির তখনকার অনলাইনে আছে। ফলে, ভেঙে গেছে ব্লগারদের কমন প্ল্যাটফর্ম। নতুন নতুন ব্লগ হয়েছে। শত্রুতা বেড়েছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি হয়েছে, আদর্শের ভিত্তিতে তরুণদের জাগরণ এবং বিভক্তি।
ব্লগের রমরমা দিন আসলে নষ্ট করেছে ফেসবুক। ফেসবুক অনেক নিরাপদ। চাইলে পরিচিতের গণ্ডিতে থাকা যায়। আবার অনেক অচেনার ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে দেওয়া যায়। এর ভালো ব্যবহার যেমন আছে, খারাপ ব্যবহারও আছে।
ফেসবুক এসে অধিকাংশ মানুষকে নিক নেম থেকে মুক্তি দিয়েছে বলা যায়। নিজের নামে, নিজের ছবি দিয়ে, বুক ফুলিয়ে কথা বলার শক্তি দিয়েছে তরুণদের। তরুণদের বলছি কেন, বড়োরাও অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বিচরণ করেন ফেসবুকের পাতায় পাতায়। আছে, আদর্শের পক্ষে জনমত গড়ার সুযোগ। যার বাস্তব উদাহরণ হয়ে থাকবে গণজাগরণমঞ্চ।
সম্পাদকের কাঁচি থেকে বেঁচে গেছে অনেকের মতামত। যার মনে যা আছে অবলীলায় বলার সুযোগ করে দিয়েছে ফেসবুক। পত্রিকা যেখানে সম্পাদনা করে, চিন্তা ভাবনা করে অন্যের মত প্রকাশ করার সুযোগ দেয় সেখানে কোনোরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়া মত প্রকাশ করার সুযোগ ফেসবুকে। সে সব কথার মাদকতা আলাদা, ঝুঁকিও বেশি।
এখন প্রশ্ন হলো, সম্পাদনা ছাড়া মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা আমাদের আছে কী না? মনে যা চিন্তা আসে তা প্রকাশ করার অধিকার আমাদের আছে কী না? এ বিষয়ে যদি কোনো বিধি-নিষেধ থাকে তবে তা কোথায়?
দেশের সবোর্চ্চ আইন সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দিয়েছে। এর মানে, আপনি যা ইচ্ছা তা চিন্তা করতে পারবেন। আপনার বিবেক যা চায় তা ভাবতে পারেন। চিন্তা ভালো হতে পারে, খারাপ হতে পারে। সুন্দর হতে পারে কদাকার হতে পারে। আপনার মনের ভেতরে যতক্ষণ তা থাকবে সেটা আপনার চিন্তা। সেই চিন্তার স্বাধীনতা শতভাগ আছে। যখন কেউ নিজের চিন্তার প্রকাশ করে তখন তা আর চিন্তা থাকে না। তখন তা মত বা বাক হয়। চিন্তাটি মুখে বললে, তা কথা হয়। কাগজে লিখলে তা লেখা হয়। তাহলে, বাক বা কথা বলা বা লেখার স্বাধীনতা কী সংবিধানে আছে? আছে, আটটি শর্ত সাপেক্ষে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংবিধান আমাদেরকে যা ইচ্ছা তা বলার স্বাধীনতা দেয় না। অথচ, অনলাইনে সুযোগ আছে যা ইচ্ছা তা বলার।
এর সুযোগ নিয়ে রাজনীতিবিদ তার স্বার্থ দেখতে পারেন, কবি রক্ষা করতে পারেন নিজের স্বার্থ, ব্যবসায়ী করতে পারেন বাণিজ্য। প্রেমিক করতে পারেন প্রেম। সব ঠিক আছে। কিন্তু একজন অন্যের স্বার্থ পদদলিত করলে, একজন অন্যের অধিকার নষ্ট করলে, একজন অন্যের জীবন সংশয়ের কারণ হলে, আইন চুপ করে বসে থাকতে পারে না। ফলে, দেখা যায় অনলাইনে আইনের নিয়ন্ত্রণের একটা সুযোগ থাকছে।
এখন কথা হলো, আইন অনলাইনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? ভুরুঙ্গামারি না হয় কাছে, হনুলুলুতো অনেক দূরে। সেদেশে কী আমাদের দেশের হুকুম চলবে? আবার আইনের ভয়ে গুটিয়ে রাখতে হবে বাক ও মতকে? সেটাও কেমন যেন। ফলে, অনলাইনে নিরাপদ বিচরণের একটা পরিবেশ এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে যারা অন্যের পাকা ধানে মই দিতে যায় না তাদের জন্যে।
এতোক্ষণ এতোসব কথা বলার কারণটা এবার বলি, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। এর প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কায় অনলাইনবাসীরা। এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। তবে সম্প্রতি সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের গ্রেফতার, এবং এ সম্পর্কিত ঘটনাবলির পর এবার ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি বেশ জোরালো। তবে আশার কথা সরকার এই ধারা পর্যালোচানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকার বাক স্বাধীনতার পক্ষে। যেহেতু ধারাটি নিয়ে কথা উঠেছে তাই সরকার পর্যালোচনা করছে। পর্যালোচনায় যদি দেখা যায় এটি বাকস্বাধীনতার অন্তরায়, তাহলে অবশ্যই এটি বাদ দেওয়া হবে। আর যদি দেখা যায় ধারাটি বাক স্বাধীনতার অন্তরায় নয়, তাহলে সেটি বহাল থাকবে।
মন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন। বাক স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর কথা বলা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। তবে, ছোট একটা দাবি জানিয়ে লেখা শেষ করি। তাহলো, ধারাটি যখন-তখন, যেখানে-সেখানে, অন্যায়ভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকে কী না, তাও পর্যালোচনা করা হোক। দুষ্টের জন্য আইন কঠোর হোক। ভালোদের জন্য অনলাইন হোক নিরাপদ এক আনন্দের ভুবন।
লেখক : সিনিয়র বার্তা সম্পাদক, দীপ্ত টিভি
এইচআর/এমএস