শ্রমিকের ঘামে-রক্তে ভেজা অর্থনীতির চাকা
বিদেশে আছি। দেশের জন্য মনটা সবসময় উচাটন থাকে। দেশের ভালো খবরে উৎফুল্ল হই, খারাপ খবরে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। সেদিন দক্ষিণ এশিয়ার ক’জন বন্ধু মিলে গেলাম বেড়াতে। কথায় কথায় উঠলো ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের প্রসঙ্গ। শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেপালের বন্ধুরা জানালেন ডলারের সঙ্গে তাদের মুদ্রার বিনিময় হারের তথ্য। এই দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো।
আমাদের টাকা ওদের মুদ্রার তুলনায় অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো এ কথা বলতে পেরে কি যে গৌরব বোধ করছিলাম তা বলার নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান কাদের? অবশ্যই এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আসে কোথা থেকে? গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা এদেশের অর্থনীতিকে বেগবান রেখেছেন একথা সকলেই জানে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সুনাম রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
আমি নিজে যখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পরে কাজে যাই তখন সহকর্মীরা প্রশ্ন করেন সেটি কোথায় তৈরি, কোনদেশের। আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে, দরদের সঙ্গে বলি এটি বাংলাদেশের তৈরি। বিশ্বমানের পোশাক তৈরি হয় আমাদের দেশে। কারা তৈরি করেন?
আমাদেরই শ্রমিকরা। আমাদেরই গরীব, অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা শ্রমিকরা। যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন তাদের সামান্য মানবিক চাহিদাগুলো পূরণে মালিক পক্ষের এত অনীহা কেন? আর মালিকদের পক্ষ হয়ে পুলিশই বা কিভাবে হামলা চালায় শ্রমিকদের উপরে?
পুলিশের বেতন তো হয় সরকারের টাকায়। আর সরকার চলে জনগণের টাকায়, দেশের সম্পদে। এই দেশের মালিক কারা? ওই শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠি নাকি আলিশান বাড়িতে থাকা কতিপয় ধনী কারখানা মালিক? এই সরকারের শ্রেণিচরিত্র কী? সরকার কার স্বার্থ সংরক্ষণ করছে? বৃহত্তর শ্রমিক সমাজের নাকি কতিপয় ক্ষমতাশালী মালিকের? এই প্রশ্নগুলো মনে জাগতে বাধ্য যখন দেখি আশুলিয়ায়, সাভারে, দক্ষিণখানে, গাজীপুরে আন্দোলনরত শ্রমিকের উপর পুলিশী হামলা চলে।
সাম্প্রতিক শ্রমিক বিক্ষোভের পিছনে রয়েছে নতুন মজুরি কাঠামো। সময়ের গতিতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। চল্লিশ টাকার নিচে তো সবচেয়ে মোটা চালও মেলে না। মাছ মাংসের কথা না হয় বাদই দিলাম। বস্তির ঘরের ভাড়াও তো কম নয়। তাহলে একজন শ্রমিক তার মজুরির টাকায় যে খেযে পরে বেঁচে থাকবেন, সন্তান প্রতিপালন করবেন সে সামর্থ্য তার আছে কি?
গার্মেন্টস এর অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। তাদের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় তারা অপুষ্টির শিকার। ছোট্ট একটি ঘরে অনেকে মিলে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এই ক্ষীণ দেহ নিয়ে শক্ত হাতে তারা দেশের অর্থনীতির হাল ধরে আছেন। তাদের যদি ন্যূনতম বাঁচার অধিকার মালিক পক্ষ না দিতে চায় তাহলে সেই মানসিকতা মানবিকতার কোন পর্যায়ে পড়ে?
নতুন মজুরি কাঠামোতে হেলপারের মজুরি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও গার্মেন্টস শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকের মজুরি খুব সামান্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। অপারেটরদের মজুরি কারখানাভেদে কোন কোন ক্ষেত্রে কমেও গিয়েছে।
শ্রমিকদের দারিদ্র্যের সঙ্গে এ ধরনের তামাশা করার মানে কি? উপরন্তু আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপরে চলছে পুলিশী নির্যাতন। শ্রমিক হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ব্রিটিশ শাসক, পাকিস্তানি শাসকদের মতো স্বাধীন দেশের সরকারও যদি শ্রমিকদের উপরে হামলার পথই বেছে নেয় তাহলে দুঃখের আর সীমা থাকে না।
অবিলম্বে শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়া দরকার। শ্রমিকের দাবি মেনে নিতে গিয়ে মালিকের মুনাফা যদি কিছু কমও হয়, দামি লেক্সাসে যদি নাই চড়তে পারেন তাও ভালো। দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো, উন্নয়নের জন্য ভালো।
একদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য অন্যদিকে ভোগবিলাস কোনদিনই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর দমন নিপীড়ন বন্ধ করে অবিলম্বে এই সমস্যার সুষ্ঠু ও মানবিক সমাধানের দাবি জানাচ্ছি। সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করে দেশের বৃহত্তম শিল্পখাতকে সচল রাখুক এই প্রত্যাশা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের।
এইচআর/আরআইপি