ভালোবাসা কারে কয়...
ভালোবাসার `ফাঁদ` পেতে বিয়ে করে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের খবর নতুন নয়। বরং এরকম খবরের জন্য দৈনিক পত্রিকাগুলোর কিছু জায়গা বরাদ্দ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই পত্রিকা খুললে দেখা যায় কেউ হয়তো স্বামীর হাতে খুন হয়েছে, কোথাও কোথাও সেই খুনে সহায়তা করেছে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ, ভাসুর, দেবর, জা। কারো স্বামী হয়তো চোখ উপড়ে নিয়েছে। কারো স্বামী হয়তো পা ভেঙে দিয়েছে। এরকম অসংখ্য নির্যাতনের চিত্র পত্রিকা খুললেই দেখা যায়। এরকম অসংখ্য দুর্বিষহ খবরের লিংক ভেসে বেড়ায় ফেসবুকের ওয়ালজুড়ে। আমাদের দেশে প্রতিদিনই এরকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য নারী। যারা তা প্রকাশ করেন, তাদের খবর আমরা জানি। যারা প্রকাশ করেন না, আমরা তা জানতে পারি না।
প্রথমেই আসা যাক ভালোবাসার `ফাঁদ`-এর ব্যাপারটিতে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সম্পর্কই তৈরি হয় মোবাইল ফোন কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে। অর্থাৎ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন থাকে অপরজনের কাছে অচেনা, অজানা। আর অচেনাকে চেনার দুর্বার আকর্ষণেই সম্ভবত প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হতে খুব একটা সময় লাগে না। তরুণী অথবা কিশোরী মেয়েটি, যে ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে, সে প্রথম ভুলটা করে এখানেই। ছেলেটি মিষ্টি করে একবার `জান` বলে ডাকলেই, দুটি মন ভোলানো কথা বললেই মেয়েটি গলে যায়। ছেলেটির এক কথায় নারীজীবনের মূল্যবান সম্বল তার কাছে বিলিয়ে দিতেও দেরি করে না! যে যেভাবেই যুক্তি দেখাক না কেন, এই সমাজে ভালোবাসার সম্পর্কে মেয়েটির দায়ই বেশি থাকে! মেয়েটি বিয়ের আগেই গর্ভবতী হয়ে পড়লে ছেলেটি কোনোরকম দায় না নিয়েই সরে পড়তে পারে, কিন্তু মেয়েটি তা পারে না। সমাজের চোখে `নষ্ট মেয়ে`টি শত গঞ্জনা সয়েও গর্ভের সন্তানটিকে বয়ে বেড়ায় অথবা গঞ্জনা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়! তাই মেয়েদেরকেই সবার আগে সচেতন হতে হবে। সরে আসতে হবে বোকামির পথ থেকে। কাউকে ভালোবাসার আগে তার সম্পর্কে সবকিছু জেনে নেয়াটাই কি বুদ্ধিমতির লক্ষণ নয়?
ধরা যাক, এরপরও প্রেম হয়ে গেল। এবং ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বিয়েও হলো। বিয়ের পরে যখন ছেলেটির আসল রূপ প্রকাশ পেতে থাকে, তখন অধিকাংশ মেয়েই তা পরিবারের কাছে, আশেপাশের মানুষজনের কাছে চেপে যায়! আর যেকোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলেই তা মাথায় চড়ে বসে, এটাই অন্যায়ের ধর্ম। যে স্বামী তার স্ত্রীকে নির্যাতন করে এবং যে স্ত্রী তা মুখ বুজে সহ্য করে, তারা দুজনই সমান অপরাধী। এরপর দেখা যায় মেয়েটির পরিবারে নির্যাতনের খবর পৌঁছলে মেয়ের `সুখের জন্য` সাধ্যমতো `যৌতুক` পাঠানো হয়। যেখানে দেশের আইনে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া সমান অপরাধ সেখানে যৌতুক দেয়ার মাধ্যমে মেয়ের পরিবারটিও কি ছেলের পরিবারের সমান অপরাধী হচ্ছে না? মেয়ের পরিবার হয়তো বলতে চেষ্টা করবে তারা মেয়ের সুখের জন্যই সব করেছে। কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে দেখে না একজন যৌতুকলোভী, নির্যাতনকারী অমানুষের কাছে তাদের মেয়েটি কী করে ভালো থাকবে! এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ছেলেই চায়, শ্বশুরবাড়ির টাকায় প্রতিষ্ঠিত হতে। অথচ রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় সকল বিধি অনুসারে মেয়েটির ভরণপোষণের দায়িত্ব থাকে তার স্বামীর। নিজের দায়িত্ব যে অন্যের ঘাড়ে চাপায়, সে মেরুদণ্ডহীন। এবং যার মেরুদণ্ড নেই তাকে টাকা দিয়ে কী করে প্রতিষ্ঠিত করা যায়!
আমাদের তাই মূল্যবোধের জায়গাটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। স্বকীয়তা কীভাবে বজায় রাখা যায়, তা জানা দরকার। অন্যের কাছে নিজেকে নিজেই স্বস্তা করে তুললে সে তোমাকে কেন মূল্য দেবে! নিজের পছন্দমতো ভালোবাসার অধিকার যেমন আছে, তেমনি কোনো ভুল মানুষকে ভালোবাসার অধিকার আমাদের নেই। কারণ, একটি দুর্ঘটনা কিংবা অপরাধ সৃষ্টি হলে তখন আর তা কারো ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে না। সমাজের সর্বস্তরেই তার বিষ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ নষ্ট করার কিংবা নিজের জীবনকে বিপন্ন করার কোনো অধিকারই আমাদের নেই। আর আমরা তো সমাজেরই অংশ। তাই কেউ `বিয়ের প্রলোভন` দেখালেই তার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার আগে ভেবে দেখা উচিৎ নয় কি? বিয়ের প্রলোভনে পড়ে নিজেকে উজাড় করার থেকে বিয়ে করে নেয়া অথবা বিয়ে না করে থাকাই তো উত্তম! ভালোবাসায় যেকোনো রকম শর্তারোপ মানেই তা আসলে ভালোবাসা নয়, শর্তটি যে দিচ্ছে তার মনোবাসনা পূরণের একটি কৌশলমাত্র। মেয়েরা যতদিন পর্যন্ত না সেই কৌশলে ধরা দেয়া থেকে বিরত হবে, ততদিন পর্যন্ত হয়তো এরকম খবরের শিরোনাম চলতেই থাকবে। বিয়ের আগে এবং পরে, যখনই সে জেনে বুঝে কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে, সেই বিভীষিকায় তখন তাকেই নিঃশেষ হতে হবে। অন্যায়কারী এবং অন্যায়ের প্রশয়দানকারী দুজনেই যে সমান!
লেখক : সাংবাদিক
এইচআর/পিআর