অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে আর কত প্রাণ যাবে?
রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। কোনোভাবেই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছেনা। অরক্ষিত রেলক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত সংযোগ এবং সচেতনতার অভাবে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে। গত শুক্রবারও চার জন মারা গেছে। আহত হয়েছে ১০ জন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার শোলাকুড়া লেভেলক্রসিংয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের বাঘুটিয়া গ্রামের শহীদ শেখের ছেলে সরোয়ার শেখ (২০), এলেম সরদারের ছেলে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িচালক ইমরান সরদার (২২), জামালপুর ইউনিয়নের তুলশীবরাট গ্রামের শুকুর আলী শেখের ছেলে শাকের আলী শেখ (২০) ও একই গ্রামের আলেক মৃধার ছেলে ফজলু মৃধা (৩০)।
ফরিদপুরের মধুখালীর রাজ্জাক জুট মিলের শ্রমিকবাহী শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নছিমন শোলাকুড়া লেভেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেন এসে ধাক্কা দেয়। রাজবাড়ীর কালুখালী থেকে মেইল ট্রেনটি যাচ্ছিল গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়া। নছিমনচালক দ্রুতগতিতে রেলক্রসিং পার হওয়ার চেষ্টা করে। তখন ট্রেনটি এসে নছিমনকে ধাক্কা দেয়। ট্রেনের সামনের অংশে আটকে পড়ায় নছিমনটিকে প্রায় আধা কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়।
গত আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) মারা গেছেন আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন আরও ছয় শতাধিক। শুধু রেলওয়ে পুলিশের হিসাব মতে, মৃত্যুর সংখ্যা ৭০০। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রমতে ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৮ ও নারী ৪৪ জন। অপমৃত্যু (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সাল রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৪ ও নারী ৬১ জন। ইউডি মামলাসহ মোট মামলা ৩০৫টি। গত বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মারা যান।
অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী। রেলওয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা, সিগন্যাল লাইনে ত্রুটি এবং উন্নয়ন কাজ চলা অবস্থায় ট্রেন লুপ লাইন কিংবা সাইড লাইনে চলে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
রেল যোগাযোগ অনেকটা সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হওয়ায় লোকজন রেলে যাতায়াত করে থাকে। সরকারও রেলের প্রভূত উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মেট্রো রেলের যুগেও প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ। ভবিষ্যতে রেলপথও বাড়বে। কিন্তু সে তুলনায় নিরাপদ হয়নি রেল যোগাযোগ। রেলপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এমনিতে রেলপথের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সাধারণের প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু এই আইন বাংলাদেশের মতো দেশে মেনে চলা হয় কি?
সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে লেভেলক্রসিং। দেশের দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় দুই হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এর বেশির ভাগেই কোনো গেট নেই। কোনো সংকেতবাতি দূরের কথা, নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মী। নিয়ম অনুযায়ী কোনো রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নিয়ে যেতে হলে গেট নির্মাণ, কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
সর্বশেষ গত শুক্রবারের দুর্ঘটনায় নিহতের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দুই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে কারও কোনো অবহেলা থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। রেল যোগাযোগ নিরাপদ করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাতে হবে।
এইচআর/আরআইপি