প্রভু তুমি আমায় কচ্ছপের আয়ু দাও, কিন্তু কচ্ছপের জীবন দিওনা
খানিকক্ষণ আগেই একটা কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। লিফট ছিঁড়ে সোজা এক ঝটকায় ন’তলা থেকে এক তলায়। অভিজ্ঞতাটা আদৌ সুখকর না। ওভারলোডেড লিফট বোঝাই অসংখ্য মানুষের চিৎকার, ছোটাছুটি আর এর মধ্যেই তিন দফায় তিনটা ঝাকি খেয়ে লিফটা এক তলায় ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রচণ্ড শব্দে। ‘মৃত্যুর মুখে পড়া’ টাইপ একটা অভিজ্ঞতা নিংসন্দেহে!
জীবন ক্ষণস্থায়ী। প্রায়ই ভুলে বসি আমরা তা। এসব অভিজ্ঞতা একদিক থেকে ভালো, কারণ তা আমাদের ক্ষণস্থায়ীত্ব চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ অভিজ্ঞতা আমার অল্প বয়সে বার কয়েক হয়েছে। বর্তমানের মাননীয় ধর্ম মন্ত্রীমহোদয়ের সাথে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনী প্রচারণা আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ আয়োজিত সাংস্কৃতিক উৎসব পণ্ড করায় ছাত্রদলের বন্ধুদের নির্বিচার বুলেট উৎসবে মৃত্যুকে দেখেছি কাছ থেকে।
মৃত্যুকে দেখেছি আমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের সমাধিতে যাবার পথে আর ৯৬’এর ২৬ মার্চ চলমান অসহযোগ আন্দোলনের শিথিলতার সুযোগে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পরেও। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতাটা কেন যেন একটু অন্যরকম। একটু দার্শনিকতায় পেয়ে বসলো কেন যেন!
বাংলাদেশ’র সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘মানুষ বাঁচে সত্তর বছর, অথচ কচ্ছপের আয়ু তিনশ বছরের। উল্টোটা হলেই বরং যৌক্তিক হত’। হয়নি, তবে হবে হয়তো। আমার অগ্রজ সহকর্মী, সহগবেষক ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সেমিনারে বক্তৃতায় জানাচ্ছিলেন এ নিয়ে গবেষণায় অসম্ভব অগ্রগতির কথা। আশাবাদী ফজলে আকবরের আশার বাণী - ‘আগামী দু’তিন দশকের মধ্যে বিজ্ঞানীরা হয়তো মানুষের গড় আয়ুকে একশ’র উপর টেনে তুলতে পারবেন’।
আমার সুকন্যা-সূর্য হয়তো কচ্ছপের কাছাকাছি বয়স পর্যন্ত পৃথিবীর আলো বাতাসে ঘুরে বেড়াবে, তারা না পারলেও হয়তো পারবে তাদের সুকন্যা-সূর্যরা। আমাকেতো কচ্ছপের এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ আয়ু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তাও যদি সেদিনের মত আরো কোন লিফট আমাকে নিয়ে সজোরে নিচে নেমে নিয়ে না আসে বা নিয়তিতে তার চেয়েও অকস্মাৎ কোন কিছু নির্ধারিত না হয়ে থেকে থাকে।
আর এই যদি হবে বাস্তবতা, তবে এত সব, এত কিছু কীসের জন্য? কীসের পেছনে, কেন এই হতচ্ছাড়া দৌড়াদৌড়ি? না- আমি নিরাশাবাদী নই। বরং এর ঠিক উল্টোটি। স্রষ্টার প্রতি আমার তেমন কোন অভাব-অভিযোগ নেই। আমার ধারণা তিনি আমাকে আমার যোগ্যতার যেয়ে বেশিই মূল্যায়ন করেছেন।
তারপরও তার প্রতি আমার দু’একটা ছোটখাট অনুযোগ- তার অন্যতম হচ্ছে কচ্ছপের চেয়ে আয়ু অনেক কম পেয়েছি আপাততঃ ঠিক আছে, কিন্তু দিনটা চব্বিশের জায়গায় ছত্রিশ কিংবা আটচল্লিশ ঘণ্টা করায় সমস্যা কি খুব বেশি ছিল? আরেকটু বেশি দেখতাম, দেখানোর চেষ্টাও করতাম আরেকটু বেশি কিছু।
লিফট ছিঁড়ে পড়ার পর আজকের এই উপলব্ধিটা একটু অন্য কারণে। কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, অনেকের কাছেই অনেক বেশি শ্রদ্ধেয়ও বটে- আইন বা চিকিৎসা পেশায় তাদের সুনাম যে ঈর্ষণীয়, আমিও বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নিতে সম্মত। আমি ব্যথিত হই তাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণে আর রাজনীতির দর্শনে। আমি নগণ্য, আমার আপত্তি তাদের গ্রাহ্যে আসবে এমনটি প্রত্যাশাও আমি করিনা। তবুও অবুঝ কলমটা ছোটে!
তাদের একজন রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রণেতা। ছিলেন বঙ্গবন্ধুরও আস্থা ভাজন। জীবনে একবারই সংসদে যাবার সুযোগে যে সাবেক সাংসদের তকমা এটেছেন তাও বঙ্গবন্ধুরই করুণায়, বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে আসা আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে। একাত্তরে তার ভূমিকা নিয়ে দু’জন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার লেখা বইয়ে সম্প্রতি অন্যরকম তথ্য উঠে এসেছে। জানা যাচ্ছে তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতিতে।
সত্যি-মিথ্যা জানিনা, তবে সত্যি হবার সম্ভবনাই বেশি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আইনজ্ঞ আর তার নিকট আত্মীয়দের ইদানিংকার কার্যক্রম তো প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে পাকিস্তানী স্বার্থের পক্ষেই যায়। এ জন্য অবশ্য আমি তাকে খুব একটা দোষ দেইনা। সবাইতো আর রুমী-আজাদ হবেন না। হয়তো এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তাটা তাকে অনেক বেশি আকৃষ্ট করেছিল, হয়তো তা দেশমাতৃকার প্রতি তার দায়িত্ববোধকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। যেতেই পারে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সময়ে অর্জিত আরো অনেক সাফল্যের অন্যতম হচ্ছে বাঙালিদের প্রলম্বিত গড় আয়ু। প্রাকৃতিক নিয়মে তিনি সেই বাড়তি আয়ুটুকুও পার করে বর্তমানে পৃথিবীতে ওভারটাইম করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন। অতএব সংগত কারণেই তার সেই পার্থিব আকর্ষণগুলো এই পরিণত বয়সে তার চিন্তাকে প্রভাবিত করবে এমনটি আর প্রত্যাশিত নয়। তবে আর কেন? আবার কেন?
অন্যজন আরো বয়োজ্যেষ্ঠ, আমার প্রয়াত শ্বশুর শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরীর ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহপাঠী। পরবর্তীতে বিলেত থেকে পাস দেয়া স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও বটে। ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মধ্যবয়সে দিকভ্রান্ত হয়ে ভুল রাজনীতির সহযাত্রী হয়েছেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য, তাও সেই অপরাজনীতির হাত ধরেই।
বিদায়টা অবশ্য বিধুর ছিল। মহাখালী রেলক্রসিংয়ে ক্ষমতাসীনদের হাতে নাকাল হয়েছেন। তিনি সয়েছেন সেই অপমান। ফিরেওছেন রাজনীতিতে। প্রত্যাশা ছিল আলোর পথের সহযাত্রী হবেন, যা কিছু ভাল তার পক্ষে দাঁড়াবেন। উনিওতো তেমনি একজন সৌভাগ্যবান যিনি বাঙালির গড় আয়ুকে অতিক্রম করে কচ্ছপের আয়ুর দিকে ধাবমান। তিনিতো তার মেডিকেল কলেজের সহপাঠী শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী কিংবা শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর চেয়ে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান, যারা বাঙালির গড় আয়ুর অর্ধেকও ভোগ করে যেতে পারেননি। তবে আরো কেন? কীসের জন্য?
জানিনা - তবে জানি এই জীবন প্রত্যাশিত নয়। ছিঁড়ে পড়া লিফট থেকে হুড়মুড়িয়ে বেড়িয়ে আসা লোকগুলোর পিছন পিছন বেড়িয়ে এসে যখন স্রষ্টাকে পঞ্চমবারের মত আমাকে সুযোগ দেয়ায় যখন ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তখন আমার প্রার্থনা, ‘হে প্রভু ধন্যবাদ! তুমি আমায় আবারও সুযোগ দিয়েছো। তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অশেষ। আমায় তুমি আরো করুণা কর, যাতে আমি বাঙালির গড় আয়ুকে ছাড়িয়ে যেতে পারি। প্রভু তুমি আমায় কচ্ছপের আয়ু দাও, কিন্তু দোহাই তোমার আমায় তুমি কচ্ছপের জীবন দিওনা’!
লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/আরআইপি