নারী শক্তির বিজয়কাব্যের নামই দুর্গাপূজা
শারদীয় শুভেচ্ছা সকলকে। দেখতে দেখতে পূজার আয়োজন প্রায় শেষের পথে। পূজা শেষ হয়ে গেলেও এর শিক্ষাটা যেন থেকে যায় সকলের হৃদয়ে সেই কামনা করছি। সেটা না হলে দেবীর এ পূজা হবে নিছক আনুষ্ঠানিকতার বৃত্তে সীমাবদ্ধ। যা প্রকৃতপ্রস্তাবে আসলেই মূল্যহীন একটা বিষয় হয়ে উঠবে। দুর্গা পূজার শিক্ষাটা তাই আমরা যেন ভুলে না গিয়ে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি -- সেই কামনাও করছি।
শিউলি ফুলের সুগন্ধের সাথে ধূপধুনোর এক চমৎকার যুগলের উপলক্ষ্য হয়ে প্রতি বছর শরতে দেবী দুর্গা আসেন মর্ত্যে। দেবীর এ আগমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য চির আনন্দের বার্তা হয়ে আসে। ভক্তকুল তাদের হৃদয় উৎসারিত আবেগ দিয়ে দেবী দুর্গার এ অকালবোধনকে স্বাগত জানায়। দেবীর চরণে নিজেকে সমর্পণ করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার এক অসীম প্রেরণা লাভ করে।
ত্রেতাযুগে রাজা রামচন্দ্র রাক্ষসরাজা রাবনের কবল থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন এ সময়ে; মানে শরৎকালে। তারপর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছ দেবী দুর্গার শরৎকালে পূজিত হওয়ার প্রচলন শুরু হয়। যদিও একশ বছরব্যাপী যুদ্ধ শেষে দেবতাদের তাড়িয়ে দিয়ে স্বর্গলোকে যখন রাক্ষস রাজত্ব শুরু হয়, দেবতারা তখন ছদ্মবেশে প্রাণ ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারই এক পর্যায়ে দেবতারা শরণাপন্ন হন প্রজাপতি ব্রহ্মার। পরে সকলে মিলে উপস্থিত হন শিব ও নারায়ণের সমীপে। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে যে নারীরূপের সৃষ্টি হয় এবং সেই নারী শক্তির কাছেই পরিশেষে প্রতাপশালী মহিষাসুর বধ হন- এটাই বহুল প্রচলিত দেবী দুর্গার সৃষ্টি ইতিহাস। অর্থাৎ অশুভ, অত্যাচারী, নিপীড়নকারী শক্তির বিরুদ্ধে শুভ, নিপীড়িত, নির্যাতিত শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসের বিজয়ের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় দেবী দুর্গার এ আরাধনা।
দুর্গাপূজার এটা যদি হয় ভাবগত এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য তাহলে এর একটা বাহ্যত বস্তুগত তাৎপর্যও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একজন নারী যাকে আমরা কেবলি কোমল হৃদয়, প্রতিবাদহীনা দেখতে অভ্যস্থ তার হাতে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, অশুভ শক্তির পরাজয় বস্তুতপক্ষে নারীশক্তির জাগরণের ইঙ্গিত বহন করে। নারী মানেই যে অবলা নয়, নারী মানেই যে শুধুই মুখ বুজে সয়ে যাওয়া কোনো মনুষ্যজীব নয়- দেবী দুর্গার জন্ম ইতিহাস সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আজ যখন নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে নানা মাত্রায়, নারী ঘরে-বাইরে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে-তখন দেবী দুর্গার পূজা অত্যন্ত সময়োপযোগী। নারীকে সম্মান করার শিক্ষা যেমন এতে প্রতিভাত হয়ে ওঠে তেমনিভাবে নারী নিজেই যে এক প্রতিবাদী চরিত্র সেটারও স্বীকৃতি মিলে অতি সহজেই। বাস্তবতার নিরিখে ভাবগত ইতিহাসের পাশাপাশি তাই বস্তুগত স্বীকৃতিও নারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে এ পূজার মাধ্যমে।
পাশাপাশি পূজাকেন্দ্রিক ৫ দিনব্যাপী যে আনন্দযজ্ঞ চলে; পারস্পারিক সৌহার্দ্য এবং সৌভাতৃত্ববোধের যে অমীয় ফল্গুধারা বহমান হয় সেটাও উত্তেজনাপূর্ণ বিশ্ব পরিস্থিতিতে বেশ খানিকটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।অন্ত এবং আন্তধর্মীয় ভালোবাসা, শান্তি এবং কল্যাণময়তাকে উপরোক্ত বোধ পরম আদরে লালনপালন করে থাকে। সাম্প্রদায়িক বিষের বিরুদ্ধেও যা চমৎকার "এন্টিডট" হিসেবে কাজ করে থাকে। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে " ধর্ম যার যার, উৎসব সবার"।
উৎসবকেন্দ্রিক মানুষে মানুষে যে মিলনমেলা এবং ভাববিনিময় চলে সেটাই শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উৎসবের উপলক্ষ দিয়ে এমন সমাজ বিনির্মাণ করা যতটা সহজ অন্য কোনোভাবে সেটা হয়ত সম্ভবপর নয়।
পরিশেষে, সকলকে আবারও শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে সবার মঙ্গলময় জীবন কামনা করছি। মঙ্গলময় হয়ে উঠুক সবার জীবন। শান্তিময় হয়ে উঠুক পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা পুরো বিশ্ব।
লেখক:চিকিৎসক, শিক্ষক।
এইচআর/আরআইপি