অটিজম এবং বয়ঃসন্ধি
কিছুদিন আগে দোকানে গেছি কেনাকাটা করতে। বিশাল দোকান, সপ্তাহের শাক সবজি কিনব বলে ঠাণ্ডা হিম হিম সেকশনটায় ঢুকলাম। এতো ঠাণ্ডা যে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। তাড়াহুড়ো করে টপাটপ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো তুলে বের হয়ে আসব, তখনই চোখে পড়ল একটি ছেলের উপরে। বয়স বিশ/বাইশ হবে। আমার ছেলের কাছাকাছি বয়স।
ছেলেটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বাভাবিক না। সঙ্গের মহিলা মনে হয় মা। এই যুবক ছেলেটি দোকানের এতো মানুষের মাঝেই মাকে জোরে চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। অন্য যে কোন মা হলে ভীষণ বিব্রত হত। এদেশে বড় হয়ে যাওয়া ছেলে পাবলিক প্লেসে মেয়েরা মা, বাবাদের হাত পর্যন্ত ধরতে অস্বস্তি বোধ করে।
কিন্তু মহিলাকে দেখে মনে হল সে এসবে অভ্যস্ত, তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিরক্তিও নেই। সে ধৈর্য ধরে ছেলেটিকে সরিয়ে অকে সাথে নিয়েই বাজার করছে। এই অটিস্টিক বাচ্চার মা তার বাচ্চা নিয়ে বিব্রত না, তটস্থ না, আশে পাশের সবাই এ বিষয়ে অবহিত, সহানুভূতিশীল।
আমি যেই জিমে যাই, আমি সেখানে খুব একটা নিয়মিত না। এক সপ্তাহ গেলে দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকে এরকম অবস্থা। কিন্তু যেদিনই যাই না কেন, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বার মাস এক মা তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে জিমে আসে। মা বসে থাকে। ছেলে ব্যায়াম করে। লাফায়।
হাসে, দৌড়ায়, চিৎকার দেয়। কেউ কিছু বলে না। আমার মা’টার জন্য এতো মায়া হয়। প্রতিদিন মহিলা ধৈর্য ধরে বসে থাকে। এই অবুঝ কিশোরের প্রাণ শক্তি যেন কিছুটা খরচ হয়, সে জন্য মায়ের এই চেষ্টা। নাহলে ওই বয়সী অটিস্টিক ছেলেকে বাসায় সামলানো ভীষণ কষ্ট।
কিছুদিন আগে ক্যম্পিঙ্গে গিয়ছিলাম কিছু পরিচিত বাঙ্গালি পরিবার মিলে। একটি পরিবার গিয়েছিল যাদের ছিল একটি অটিস্টিক কিশোর ছেলে। এই ছেলেটিকে শিশু অবস্থায়ও আমি দেখেছি। এবার বেশ বড় হয়ে গেছে। সঙ্গে শুধু বাবা। ছেলের বাবা প্রথম দিনেই সবাইকে ছেলে সম্পর্কে জানিয়ে দিল।
এই ছেলেটি আপন মনে হাসছে, কিছুক্ষণ পর পর জোরে চিৎকার করছে। বাবাকে ছেলের দিকে অনেক খেয়াল রাখতে হচ্ছে। এমনকি ছেলেটির ছোট বোন, যে ওর চেয়ে অনেক ছোট সেও খেয়াল রাখছে। সে নিজে বাথরুমে যেতে পারে, খেতে পারে এটাই যেন বাবা মায়ের জন্য অনেক বেশি পাওয়া।
অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে বাবা, মায়ের যে কষ্ট সেটা আমরা সবাই কম বেশি ধারণা করতে পারি। তবে এই কষ্ট আরও বহুগুণে বেড়ে যায় এদের পিউবারটি আসলে। প্রকৃতির নিয়মে শরীর বাড়তে থাকে, হরমোনের পরিবর্তন হয়, আস্তে আস্তে শরীরের চাহিদাও যোগ হয়।
মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। তখন এদেরকে সামলে রাখা কঠিন কাজ। মন শিশুর মত, সমাজ, সামাজিকতা, ধর্ম কিছুই বোঝে না। বাবা, মায়ের উপরে এ এক বিশাল চাপ। বিশেষ করে আমাদের মত দেশে, যেখানে পাছে লোকে কি বলে নিয়ে আমাদের ভীষণ টেনশন।
আশা করি এসব বাচ্চা, কিশোর, কিশোরী, যুবক, যুবতীর প্রতি এবং তাদের বাবা-মায়ের প্রতি সবাই সহানুভূতিশীল হবেন। আপাত দৃষ্টিতে স্পর্শকাতর এইসব বিষয় গুলোকেও সবাই উদার মন নিয়ে দেখবেন এদের ক্ষেত্রে যেন এদের মা, বাবাদের কোন সঙ্কোচ না হয়, তারা মন ছোট করে না থাকেন। চার পাশের সবার সহযোগিতা পেলে তাদের জীবন কিছুটা হলেও সহজ হবে।
এইচআর/আরআইপি