২১ আগস্ট : রাজনৈতিক মামলা নয়, রাজনীতিকেই হত্যাচেষ্টা
মূল আসামীরা রাজনীতির সাথে জড়িত। তবু এ মামলা রাজনৈতিক নয়। এটি স্পষ্টত হত্যা মামলা, যার পেছনে ছিল গভীর এক ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রিসভার সদস্য, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জঙ্গীদের দমন করা। সেখানে রাষ্ট্র জঙ্গীদের হাতে গ্রেনেড তুলে দিয়েছিল বিরোধীদলীয় নেতাকে হত্যার জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেই এমন রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের উদাহরণ বিরল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটেছিল সেই ঘৃণ্য হামলা। বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো শেখ হাসিনা সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।
ঘটনার ১৪ বছর পর এ মামলার রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রিসভার দুই সদস্য লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। এ হামলার মূল পরিকল্পনা হয়েছিল হাওয়া ভবনে। সেই দায়ে তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সাথে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে আরো ১৮ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে আরো ১১ জনের।
বাংলাদেশ যে আজ রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রবলভাবে বিভক্ত তার উৎস কিন্তু আগস্টে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যার শুরু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তা দুই পক্ষকে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে ঠেলে দিয়েছে। ২১ আগস্ট আসলে ১৫ আগস্টের দ্বিতীয় পর্ব। ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ হামলা। তবে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২২ জন প্রাণ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই আওয়ামী লীগ আর এন্টি আওয়ামী লীগ ধারায় বিভক্ত। বর্তমানে এন্টি আওয়ামী লীগ ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় শেষ পর্যন্ত বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান। ঘাতকদের সঙ্গে তার যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রেখে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার রুদ্ধ করে রেখেছিলেন, খুনিদের পুরস্কৃত করেছেন তিনি। তবুও জিয়া সরাসরি জড়িত নন, তখনও বিএনপির জন্ম হয়নি- এসব যুক্তিতে বিএনপি ১৫ আগস্টের দায় থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পায়।
কিন্তু সেই পথটা তারা নিজেরাই রুদ্ধ করেছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন ’৭৫-এর ঘাতকরা তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে গ্রেনেড নিয়ে মাঠে নেমেছিল। মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে জানা যায়, হাওয়া ভবনে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুর ঘাতক মেজর নূরও উপস্থিত ছিল।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে সেই পরিকল্পনা বৈঠকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, গোয়েন্দা প্রধানরা উপস্থিত ছিল। এটা বিশ্ব ইতিহাসেই অস্বাভাবিক। রাষ্ট্রযন্ত্র রীতিমত পরিকল্পনা করে বিরোধীদলীয় নেতাকে হত্যা করতে চায় এটা বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন।
বিরোধীদলীয় নেতাসহ দেশের সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। সে দায়িত্ব পালনে বিএনপি-জামায়াত সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে ব্যর্থতা পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারের সামনে। কিন্তু সে সুযোগটিও তারা কাজে লাগায়নি। এখন বোঝা যায়, আসলে সে সুযোগ কাজে লাগানোর ইচ্ছাও ছিল না তাদের।
আহত-নিহতদের উদ্ধারের বদলে পুলিশ ঘটনাস্থলে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়লো। বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনার গাড়িতে গুলি করা হলো। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি সরকার। নষ্ট করে ফেলা হয় সব আলামত। ঘটনার তদন্ত নিয়ে চলে মিথ্যাচারের প্রতিযোগিতা।
জজ মিয়া নামে এক নিরীহ ভবঘুরেকে ধরে এনে পুরো ঘটনার দায় তার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হয়। এমনকি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামেও চলে আষাঢ়ে গল্প রচনার প্রতিযোগিতা। সঠিক তদন্ত তো হয়ইনি, উল্টো শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন, এমন ব্যঙ্গও করা হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত সরকারের এই ধারাবাহিক ব্যর্থতাই এই ঘটনায় তাদের সস্পৃক্ততা প্রমাণ করে। এই পরম্পরাই মুফতি হান্নানের জবানবন্দিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। আদালতও ষড়যন্ত্রের স্থল হিসেবে হাওয়া ভবনের কথাই বলেছে। তাই এ ঘটনায় বিএনপির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
আজ যে সরকার বিএনপিকে কোণঠাসা করতে করতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, তার দায় যতটা আওয়ামী লীগের, বিএনপির অপরাধ তার চেয়ে কম নয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে, বিরোধ থাকবে, তর্ক থাকবে, ঝগড়া থাকবে।
কিন্তু শেখ হাসিনা ইসলামের বিরুদ্ধে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন; তাই তাকে চির বিদায় করতে হবে; হাওয়া ভবনে বসে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করতে গ্রেনেড দিয়ে জঙ্গিদের পাঠানো গণতন্ত্র নয়। আর সেই সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে, তখন গণতন্ত্র হারিয়ে যায়, রাজনীতি হারিয়ে যায়। গণতন্ত্রের সেই হারিয়ে যাওয়ার দায় আজ বহন করছে বিএনপি।
আমরা জানি, গণতন্ত্রে আলোচনার বিকল্প নেই। গত অনেকদিন ধরেই নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চলছে। এই বিরোধে বিএনপি গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আগামী নির্বাচন নিয়েও চলছে অচলাবস্থা। কেউ যদি শেখ হাসিনাকে আলোচনার পরামর্শ দেন, আর তিনি যদি জবাবে বলেন, যারা আমাকে খুন করতে চায় তাদের সঙ্গে কিসের আালোচনা? তখন আপনি কী জবাব দেবেন? তাঁকে কতটা দোষ দেবেন?
তাই ২১ আগস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতির বিভক্তি রেখা। বিএনপিকে ২১ আগস্ট মামলার বিচারের রায় মানতে হবে। যতটুকু দায় আছে, ব্যর্থতা আছে; তা স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আপনি যেমন আচরণ করবেন, তেমনই তো ফেরত পাবেন। আপনি যদি গ্রেনেড দিয়ে গণতন্ত্র কায়েম করতে চান, তাহলে আপনি প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কী রকম গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করবেন?
বিএনপি ২১ আগস্ট মামলার রায় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে অভিহিত করেছে। কিন্তু শুরুতেই বলেছি, রাজনৈতিক নেতারা আসামী হলেও এটি মোটেও রাজনৈতিক মামলা নয়। বরং এই ঘটনা রাজনীতিকে হত্যা করেছে।
নিশ্চিতভাবেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। আগামী নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। তবে রাজনীতিকে ষড়যন্ত্রমুক্ত করতেই ২১ আগস্ট মামলার রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে রাজনীতির মাঠে।
১০ অক্টোবর, ২০১৮
[email protected]
এইচআর/আরআইপি